ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় মাস্ক পরা তিন যুবক পাম্পে দাঁড়িয়ে থাকা আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান। এতে বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা চালক মো. জুলহাস মিয়া (৪০) পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান। আজ মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী আখতার উল আলম এসব কথা জানান। এ ঘটনাকে আওয়ামী লীগের নাশকতামূলক কাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
গতকাল সোমবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টার দিকে ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ভালুকজান বাজারের পেট্রলপাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া বাসচালক জুলহাস ওই এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় ফুলবাড়িয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছেন।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এসপি কাজী আখতার উল আলম জানান, ঘটনার সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাসটিতে যাত্রী শাহিদ ইসলাম বাদশা (২০) ও তাঁর মা মোছা. শারমিন সুলতানা রুমকি (৪৫) অবস্থান করছিলেন। রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা বাসের ভেতরে বসে ছিলেন। এই যাত্রীরা ভোরের আলোয় নিজ গন্তব্যে যেতে চেয়েছিলেন। এ সময় মাস্ক পরা অবস্থায় তিন যুবক এসে পাম্পে দাঁড়িয়ে থাকা আলম এশিয়া পরিবহনের বাসটিতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান। ঘটনাটি টের পেয়ে বাসের গ্লাস ভেঙে শাহিদ ও তাঁর মা শারমিন বেরিয়ে আসেন। এ সময় বাস থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান শাহিদের মা। তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। বাসে ঘুমিয়ে থাকা চালক জুলহাস মিয়া আগুনের কারণে বের হতে পারেননি। তিনি সেখানেই দগ্ধ হয়ে মারা যান।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নাশকতার উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে জানিয়ে এসপি বলেন, ‘ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, দ্রুত এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বাসে হঠাৎ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকার বিষয়টি টের পেয়ে তাঁরা নেভানোর চেষ্টা করেন এবং ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন।
ফুলবাড়িয়া ফায়ার স্টেশনের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর ইয়াসিন ইকবাল বলেন, ‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি। পরে বাসে তল্লাশি চালিয়ে সিটে পড়ে থাকা অগ্নিদগ্ধ একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।’
এদিকে ঘটনার সময় বাসটিতে থাকা যাত্রী শাহিদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটিতে একাধিকবার ফোন করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুকনুজ্জামান বলেন, এ ঘটনায় মামলা করা হয়েছে। আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার অভিযান চলমান রয়েছে।
জুলহাসের পরিবারে কান্নার রোল
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য জুলহাসকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তাঁর পরিবারের সদস্যরা। বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই কারও।
জুলহাসের মা সাজেদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তাহলে কী কারণে তাকে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হলো? আমার ছেলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। তার তিন লাখ টাকা দেনা আছে। সে মাসে ১৫ হাজার টাকার কিস্তি চালায়। এক-দেড় বছর আগে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছিলাম।’
জুলহাসের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে যারা মেরেছে, তাদের ফাঁসি চাই।’
বোন ময়না বেগম বলেন, ‘আমার ভাই সেই ছোট থেকে বাস চালায়। সে সপ্তাহে একবার করে বাড়িতে আসত। আবার চলে যেত। আমার ভাই বাসেই থাকত। আমার ছেলেমেয়ে, মা, আমি—সবাই তার টাকাতেই চলতাম। এখন আমরা কীভাবে চলব, কে আমাদের দেখবে। আমাদের দাবি, সরকার যেন আমাদের পরিবারের দায়িত্ব নেয়। সরকার দায়িত্ব না নিলে আমরা না খেয়ে মারা যাব।’
আলম এশিয়া প্রাইভেট পরিবহন লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম শাহজাহান জুলহাস উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে আর্থিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তাঁর পরিবারে কেউ যোগ্য থাকলে তাঁর প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হবে বলেও জানান।
দুর্ঘটনাকবলিত বাসটির মালিক ডা. মামুন অর রশিদ বলেন, ‘ঢাকা থেকে রাতে ফুলবাড়িয়া গাড়ি নিয়ে আসেন ড্রাইভার। ভোর সকালে স্থানীয় একজনের মাধ্যমে খবর পাই, আমার বাস গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর পর থেকে ড্রাইভার জুলহাসকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। ইঞ্জিনের কাছ থেকে যেহেতু পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ধারণা করছি লাশটি আমার ড্রাইভারের হবে।’