ছত্রাকের আক্রমণে দিশেহারা মেহেরপুরের পেঁয়াজচাষিরা। ছড়িয়ে পড়ছে এক জমি থেকে আরেক জমিতে। বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেও মিলছে না প্রতিকার। এতে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন কৃষকেরা।
এটিকে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন পারপাস ব্লাসজনিত রোগ। অন্তত পাঁচ দিন পর পর পেঁয়াজের জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করার পরামর্শ তাঁদের।
মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মিয়ারুল শেখ। এবার চার বিঘা জমিতে ভারতীয় সুখসাগর পেঁয়াজের আবাদ করেছিলেন। এর আগে পেঁয়াজের জমিতে এমন রোগ কখনোই দেখেননি তিনি। একটি ডগা প্রথমে শুকিয়ে যাচ্ছে, পরে আক্রান্ত হচ্ছে পুরো গাছ। ফলে গুটি বাঁধছে না গাছ থেকে। কাঙ্ক্ষিত ফলন পাবেন না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
শুধু মিয়ারুল নয় মুজিবনগরের শিবপুর, ভবানিপুর, বিশ্বনাথপুর, আনন্দবাস, টেংরামারীসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামে মাঠের পর মাঠের পেঁয়াজখেতগুলো আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি আর ঘন কুয়াশার পর থেকেই পেঁয়াজের খেতে এই ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দেয়।
এদিকে কৃষকদের অভিযোগ, বাজারের নামীদামি কোম্পানির ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে সদর উপজেলার উজলপুর, তেরঘোরিয়া, বন্দর, ইছাখালী, হরিরামপুরের বিভিন্ন মাঠে। কৃষকেরা বলছেন, আগে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে সহজেই সমাধান মিলত। এবারের অবস্থা ভিন্ন।
মুজিবনগরের ভবানিপুর গ্রামের পেঁয়াজচাষি হাবিবুর রহমান বলেনর, ‘আমার সাড়ে ছয় বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ জমির পেঁয়ােজ ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। প্রথমে অল্প থাকলেও দিনে দিনে পুরো জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে।’
হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘চার থেকে পাঁচ দিন পর পর বাজারের নামীদামি কোম্পানির ছত্রাকনাশক এবং সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করেও সমাধান মেলেনি। এখন বাজারের চার থেকে পাঁচটি কোম্পানির ছত্রাক একসঙ্গে মিশিয়ে ককটেল বানিয়ে জমিতে স্প্রে করছি। তার পরও কাজ হচ্ছে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পরব আমরা।’
একই উপজেলার শিবপুর গ্রামের পেঁয়াজচাষি আমজাদ গাইন বলেন, ‘১২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছি। অর্ধেকেরও বেশি জমিতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। ওষুধ ছিটিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। সার, কীটনাশক, সেচ, শ্রমিক খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। এবার ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক প্রয়োগ বেশি করতে হচ্ছে। বাড়ছে খরচ।’
‘আমরা সুখসাগর জাতের পেঁয়াজের আবাদ করে থাকি। এক বিঘা জমিতে ১৫০ থেকে ১৮০ মণ ফলন হয় এই জাতের পেঁয়াজ থেকে। এবার যা অবস্থা, বিঘাপ্রতি জমিতে ১০০ মণ ফলনও পাওয়া যাবে না। বিঘাপ্রতি জমিতে পেঁয়াজ আবাদে খরচ হয় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। এবার সেই টাকা তুলতে পারব কি না, শঙ্কা রয়েছে।’ বলেন আমজাদ গাইন।
একই গ্রামের চাষি রেজাউল হক বলেন, চলতি মৌসুমে ১১ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হয়েছে। পুরো জমিই আক্রান্ত হয়েছে এই রোগে। আর এক মাস পর পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। জেলার চাহিদা মিটিয়ে এখানকার উৎপাদিত পেঁয়াজ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।
চাষি রেজাউল হক বলেন, ‘ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ আমদানির কারণে এমনিতেই মাঝে মাঝে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। এবার আবার রোগের কারণে ফলনও কম হবে। দাম পড়ে গেলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পরব আমরা।’
ছত্রাকের বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে গবেষণার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, কৃষকদের পাঁচ দিন পর পর পেঁয়াজের জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর ফসলের ওপরে থাকা কুয়াশা পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে স্প্রে করার জন্য বলা হচ্ছে।
এই কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রতি বিঘা জমিতে পাঁচ কেজি করে পটাশ সার প্রয়োগ করার জন্যও কৃষকদের বলা হচ্ছে। কৃষকেরা যাতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন না হন, সে জন্য উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের কৃষকদের পাশে থেকে পরামর্শ দিতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।