মেঘলা এক সন্ধ্যাবেলায় ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে বসে ছিল ছেলেটি। ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই শুনে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু অবাক কাণ্ড, একবারও চোখের দিকে তাকাল না। এ রকম কারও সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া কঠিন।
ও বিক্রি করছিল প্যাটিস। আমাদের ছোটবেলায় ঢাকা শহরের কনফেকশনারিগুলোয় বনেদি খাবার ছিল তিনটি- পেস্ট্রি, প্যাটিস আর ক্রিম রোল। তখন ত্রিভুজ প্যাটিসই ছিল বেশি। চার কোনা প্যাটিস অনেক পরের ব্যাপার। আর বর্তমান ফাস্টফুড দোকানের প্যাটিস তো একেবারেই নতুন ধরনের জিনিস।
আমাদের সেই ঐতিহ্যবাহী প্যাটিস এখনো কোনো কোনো কনফেকশনারিতে টিকে আছে। তবে টিনের একধরনের উষ্ণ পাত্র হাতে করে ঘুরে বেড়ানো প্যাটিস বহুদিন দেখিনি। ঢাকনা খুলে ভেতর থেকে বের করে দেওয়া হয় সেই প্যাটিস। বেশ গরম থাকে তা।
বছর তিন-চার হলো, আবার দেখতে পাচ্ছি নানা জায়গায় ১০ টাকা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে সেই প্যাটিস। দুবার কিনে খেয়েছি। সস্তা ওই প্যাটিসের ভেতরে মাংসের বদলে যা থাকে, তা চিনতে না পারলেও খেয়েছি কেবল অতীতের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করার জন্য। নস্টালজিয়া! সেই প্যাটিস নিয়ে যখন বসে আছে ছেলেটা, তখন ওর সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে তো হবেই।
ওর নাম মো. সবুজ। কখনো তাকাচ্ছিল ধাবমান গাড়িগুলোর দিকে, কখনো পথচারীদের পায়ের দিকে, কখনো আকাশের দিকে।
সাধারণত কথা বলার সময় মানুষ মানুষের চোখের দিকে তাকায়। সবুজের সে ইচ্ছে ছিল না। কথা বলছিল ঠিকই, কিন্তু কথা বলা ওর কাজের মধ্যে পড়ে না, সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল।
‘তোমার বয়স কত ভাই?’
‘১৯’।
‘কত দিন প্যাটিস বেচার কাজ করো?’
‘পাঁচ দিন।’
‘এর আগে কী করতা?’
‘কিছুই করতাম না।’
‘পড়ালেখা করতা?’
‘না। কাজও করতাম না।’
‘তাহলে কিছু তো করতা!’
‘বাড়িতে বইয়া সময় কাটাইতাম।’
‘১৯ বছর বয়সে বাড়িতে বসে সময় কাটাতে মানে! বাড়িতে কেউ কিছু বলত না?’
‘আমি তো বাড়ির ছোট ছেলে। ছোট ছেলের কিছু অ্যাডভানটেজ আছে না?’
‘অ্যাডভানটেজ মানে কী?’
‘মানে হইল, সবাই কাজকাম করে, আমারে কয় কাজ না করলেও হইব। সময়মতো খাবিদাবি, ঘুরবি!’
‘বাহ্! এ তো একেবারে রাজার হালে থাকার মতো অবস্থা! তাহলে আবার কাজে ঢুকলা কেন?’
‘মনে হইল কিছু একটা করি।’
‘এই প্যাটিস কোত্থেকে আনো?’
‘দারুসসালাম থেকে।’
‘তারপর এত দূর এসে বিক্রি করো?’
‘হ্যাঁ নিজের এলাকায় বিক্রি করতে চাই না।’
‘নিজের এলাকা কি দারুসসালাম?’
‘হ্যাঁ ওইখানেই আমরা থাকি।’
‘আমরা মানে কারা?’
‘আব্বা-আম্মা, ভাই-বোন আর দুলাভাই।’
‘দারুসসালামে কেন বিক্রি করতে চাও না?’
‘ওখানে সবাই চেনা মানুষ। ভাত খায় বাড়িতে। প্যাটিস খাইব কেন?’
এ কথাটা আমার মাথায় আসেনি। ফার্মগেটে নানা কারণে মানুষ এসে ভিড় জমায়। কাজের তাড়ায় সব সময় খেয়ে বের হতে পারে না। তাই টুকটাক কিছু খেয়ে নেয় এখানে এসে। বিক্রিবাট্টা দারুসসালামের চেয়ে ফার্মগেটেই হওয়ার কথা বেশি।
‘দিনে কত টাকা লাভ হয় সবুজ?’
‘৪০০-৫০০ টাকা থাকে।’
আজব ব্যাপার! এই কয়েক দিনে নানা পেশার নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, সবাই লাভের অঙ্কটা বলেছে এ রকম। আয় কি সত্যিই এ রকম নাকি অভ্যাসের বশে এ রকম একটা অঙ্ক বসিয়ে নেওয়া হয়!
এর উত্তর জানা কঠিন।
দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে থাকে। তাতে মো. সবুজের মন খারাপ হয়। তারপর ও আমার দিকে তাকায় না। আমার সঙ্গে কথা বলে কোনো আনন্দ পেয়েছে বলে মনে হয় না। তাই ওকে আর জ্বালাই না। সরে আসি সামনে থেকে।
কিছু দূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকাই একটা আশা বুকে নিয়ে।
উদ্দেশ্য সফল হয়। মো. সবুজ পেছন থেকে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই প্রথম ওর চোখ দেখার সুযোগ হয়। সে চোখে আনন্দ না বিষণ্ণতা, এত দূর থেকে সেটা টের পাওয়া যায় না।