চট্টগ্রাম নগরীর চালিতাতলী হাজির পোল এলাকায় বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগের সময় গুলিতে নিহত সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলার (৪৩) লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর লাশ মর্গে নিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। বিকেলে পরিবারের সদস্যরা বাবলার লাশ নগরের বায়েজিদ বোস্তামীর চালিতাতলী এলাকার খন্দকারপাড়ার বাড়িতে নিয়ে যান।
বাবলার ছোট ভাই মো. আজিজ আজকের পত্রিকাকে জানান, এশার নামাজের পর স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে বাবলার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর লাশ দাফন করা হবে।
এর আগে গতকাল বুধবার সন্ধ্যার পর নগরীর চালিতাতলী হাজির পোল এলাকায় চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগের সময় পেছন থেকে গুলিতে বাবলার মৃত্যু হয়। তিনি চালিতাতলী এলাকার খন্দকারপাড়ার আবদুল কাদেরের ছেলে।
জানা গেছে, ঘটনার পর ওই এলাকায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। এলাকার পরিস্থিতি থমথমে। হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত, সে বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। যে দোকানের ভেতরে বাবলাকে গুলি করা হয়েছে, সেটিও বন্ধ রয়েছে।
গতকাল রাতে আবদুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, বাবলাকে গুলি করে হত্যার তিন দিন আগে মোবাইল ফোনে প্রতিপক্ষ চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড রায়হান এই হুমকি দিয়েছিলেন। সে সময় ‘তোর সময় শেষ, যা খাওয়ার খেয়ে নে’—এমন হুমকি দেওয়া হয়।
এদিকে সরোয়ার হোসেন বাবলাকে ছয় মাস আগে মোবাইল ফোনে হত্যার হুমকির একটি কলরেকর্ড আজকের পত্রিকার হাতে এসেছে। গত ২২ এপ্রিল রাউজানে যুবদল নেতা মো. ইব্রাহিম হত্যার পর রায়হান এই হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
ইব্রাহিমের চাচা আবদুল হালিমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় রায়হান চট্টগ্রামের ভাষায় বলেছিলেন, ‘চিটাংঅর মধ্যে সরোয়াইজ্জা মরিব’ (চট্টগ্রামের মধ্যে সরোয়ার মরবে)।
বাবলার বাবা আবদুল কাদের জানান, তাঁর ছেলেকে গুলি করে হত্যার আগে দুবার ‘খতম’ করার হুমকি দিয়েছিল প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপ। সাত দিন ও তিন দিন আগে এসব হুমকি এসেছিল। বাবলা এ বিষয়ে সতর্ক থাকলেও একেবারে নিজ এলাকায় ঢুকে এভাবে গুলি করার বিষয়টি তিনি তেমন আমলে নেননি। কারণ, হুমকি এসেছিল মোবাইল ফোনে।
বাবলার ছোট ভাই মো. আজিজ বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমার ভাইকে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছিল হত্যাকারীরা। ওরা বলেছিল আমার ভাইয়ের সময় আর এক সপ্তাহ আছে। ওরা একাধিকবার এক সপ্তাহ সময় আছে জানিয়ে হুমকি দিত। হুমকির ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় তারা আমার ভাইকে হত্যা করল।’
আজিজ কাতারপ্রবাসী ছিলেন। দুই বছর আগে দেশে আসেন। এলাকায় নতুন ভবন করার সময় ইট ও বালু সরবরাহের কাজ করেন। এ কারণে সাজ্জাদদের রোষানলে পড়েন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবে সাজ্জাদদের সামনে ছিলেন সরোয়ার হোসেন বাবলা।
এদিকে সরোয়ারের বাবা আবদুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, তাঁর ছেলেকে প্রায়ই হুমকি দিতেন বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী, তাঁর সহযোগী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ, মো. রায়হান ও জিশানরা। গতকাল তাঁর বাড়ি থেকে ২০০ থেকে ৩০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে দোকানে গণসংযোগ চালান বিএনপি নেতা এরশাদ উল্লাহ। একেবারে বাড়ির পাশে এসে কেউ তাঁকে হত্যা করবে, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না বাবলা। পরিবারের সদস্যরাও তা কল্পনা করেননি।
আবদুল কাদের বলেন, ‘বাড়ির পাশে বায়তুন নুর জামে মসজিদে মাগরিবের নামাজে প্রথম কাতারে এরশাদ উল্লাহ, বাবলা দ্বিতীয় কাতারে ও আমি তৃতীয় কাতারে ছিলাম। নামাজ শেষে বের হওয়ার পরই সাত থেকে আট রাউন্ড গুলি। পরে দেখলাম, আমার ছেলে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। অটোরিকশায় করে হাসপাতালের পথে রওনা দিলাম ছেলেকে কোলে নিয়ে। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য মাঝপথে রিকশা ছেড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে হাসপাতালে যাওয়ার আগেই আমার ছেলে আর নেই।’ পাঞ্জাবি ও লুঙ্গিতে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্ত নিয়েই কথা বলছিলেন তিনি।
এদিকে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করার সময় মোবাইলে লাইভে ব্যস্ত যুবককে নিয়েও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। পিস্তল হাতে হামলাকারী যুবক লাইভে থাকা যুবককে ঠেলে সামনে হাত বাড়িয়ে বাবলাকে গুলি করেন।
এ বিষয়ে বাবলার ভাই আজিজকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ভারতে অবস্থানরত সাজ্জাদ (বড় সাজ্জাদ) আমার ভাইকে গুলি করার দৃশ্য দেখতে চেয়েছিল। এটা হয়তো দেখাচ্ছিল ওই যুবক।’
ওই যুবকের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ওই যুবক অতি উৎসাহী হয়ে লাইভ করতে পারেন। তবে তাকে আমরা চিনতে পারছি না।’
গতকাল মাগরিবের নামাজের পর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া এলাকায় নির্বাচনী জনসংযোগ করছিলেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ। ‘চালিতাতলীর মাটি, এরশাদ ভাইয়ের ঘাঁটি’—এ ধরনের স্লোগানও চলছিল। একপর্যায়ে লিফলেট বিতরণের জন্য পাশের একটি দোকানে ঢোকেন এরশাদ উল্লাহ। তাঁর সঙ্গে ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী ছিলেন। হত্যাকারীরা ওই নেতা-কর্মীদের বহরে ঢুকে মিশে যায়। হঠাৎ গুলির শব্দ। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান নেতা-কর্মীরা। খুব কাছ থেকে ঘাড়ের নিচে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয় বাবলাকে। গুলিবিদ্ধ হন এরশাদ উল্লাহসহ চারজন। এরশাদ উল্লাহসহ অন্যরা নগরের বেসরকারি হাসপাতাল এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন। তাঁরা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের জিএম রাম প্রসাদ।