হোম > বিশ্লেষণ

এশিয়ায় জ্বালানি সংকটে সংকুচিত হচ্ছে উৎপাদন, ভুগবে সারা বিশ্বই

আব্দুর রহমান

বিশ্বের উৎপাদন কারখানা হিসেবে পরিচিত এশিয়ায় দেখা দিয়েছে চরম জ্বালানি সংকট, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সংকট দেখা দিয়েছে জ্বালানি এবং বিদ্যুতেরও। অধিকাংশ দেশেই দেখা দিয়েছে উৎপাদন সংকোচন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এশিয়ার এই সংকট ও উৎপাদন সংকোচন আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং এর ফলে ভুগবে সারা বিশ্বই। অনেক বিশ্লেষক মহামন্দারও আশঙ্কা করছেন।

এশিয়ার সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা দুটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। একটি করোনা মহামারি এবং অপরটি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বাহ্যিকভাবে এই দুই কারণ প্রধান হিসেবে থাকলেও একেবারে মাইক্রো লেভেলে জনগণের চাহিদার সঙ্গে জোগানের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হওয়ারও অন্যতম কারণ এটি। এ ছাড়া এশিয়ার দেশ জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এসব দেশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন কাঁচামালের সরবরাহ কমে যাওয়া, সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়া এবং কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির মতো বিষয়কে।

দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো ছাড়াও উন্নত দেশগুলোতে কামড় বসাতে শুরু করেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক নিবন্ধে দেওয়া তথ্যমতে, অস্ট্রেলিয়ায় ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৪১ শতাংশ। দেশটির সরকার জনগণকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে বলেছে। একই আহ্বান জানিয়েছে জাপান সরকার। তাইওয়ানেও চলছে বিদ্যুৎ সংকট। ভারতও বিদ্যুৎ সংকট মেটাতে ২০১৫ সালের পর এই প্রথম কয়লা আমদানি করতে যাচ্ছে।

এশিয়ার অধিকাংশ দেশের উৎপাদন কমলেও উৎপাদন বেড়েছে চীনের। তবে কেবল চীনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়াটাকে বিপদের কারণও বলছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, চীনের এই একক উত্থান যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের দেশগুলোসহ বিশ্বের বড় বড় ভোক্তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক বিশ্লেষক সেসব দেশে মহামন্দারও আশঙ্কা করছেন।

কেন এই সংকট
বিগত দুই বছর করোনা মহামারি থাকায় বিশ্বে বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য জ্বালানির চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু আবারও সবকিছু স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসায় বিদ্যুতের চাহিদা আবারও বেড়েছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জ্বালানি চাহিদাও। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট তেল-গ্যাসের বাজার অস্থিতিশীল করে দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে এক আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের পরিচালক সামান্থা গ্রস বলেছেন, ‘কোভিড মহামারির পর বিশ্বে পণ্যের চাহিদা যতটা বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে জ্বালানি চাহিদা। তাই রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের আগেও আমরা জ্বালানির দাম বাড়তে দেখেছি। মূল্য হ্রাসে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো ততটা সফল হওয়া যায়নি।’

জ্বালানির বাজারে মহামারির যে আঘাত, তা আরও গভীর করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট। বিশ্বে তেল ও গ্যাসের অন্যতম উৎপাদক রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটি জ্বালানি রপ্তানি করতে পারছে না। ফলে বিদ্যমান জ্বালানি উৎপাদনের ওপর চাপ পড়েছে চাহিদা মেটানোর। এ কারণেই বিগত কয়েক মাস ধরে অস্থির হয়ে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি বাজার। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। তা হলো—রাশিয়া ও ইউক্রেন—কোনো দেশেরই খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে না পারা। এ কারণে বিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতেও খাদ্যের দাম বাড়ছে।

কিন্তু এশিয়াই কেন
এই সময়ে কেবল জ্বালানি তেল বা গ্যাসেরই দাম বাড়েনি। দাম বেড়েছে কয়লারও। গত দুই বছরের মধ্যে কয়লার দাম বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ এবং গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এবং এই মূল্য বৃদ্ধিকেই বিশ্লেষকেরা এশিয়ার সংকটের কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ, এশিয়ার অধিকাংশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশই তাদের উৎপাদন বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় শক্তির চাহিদা মেটানোর জন্য গ্যাস ও কয়লার ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এশিয়ার দেশগুলোর পক্ষে জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ হলো, এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাজার কোভিডকালে দুর্বল হয়ে যাওয়া। ফলে দেশগুলোর পক্ষে আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মুডিস অ্যানালিটিকসের মার্ক জান্ডি কিছুদিন আগে সিএনএনকে বলেছেন, ‘যদি আপনি শ্রীলঙ্কার মতো উদীয়মান কোনো অর্থনীতির দেশ হন, এবং আপনাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক দ্রব্যের পাশাপাশি জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে হয়, তবে সেটা আপনার জন্য বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন গ্লোবালের সিনিয়র রিসার্চ স্কলার অ্যান্টোইন হালফ বলেছেন, ‘দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনো উন্নয়নশীল বা নতুন শিল্পোন্নত, তারা আরও গভীর সংকটে রয়েছে। কারণ, তারা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে ততটা সক্ষম নয়। এসব দেশের আমদানির পরিমাণ যত বাড়বে, সমস্যা তত বড় হবে।’ হালফ আরও বলেন, এসব দেশের তালিকায় শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অবস্থান সবার আগে। আগামী দিনে জ্বালানি সংকট মোকাবিলা নিয়ে আরও বেশি সংকটে পড়তে হবে।

এশিয়ার উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলাফল
এদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কঠোর নীতি গ্রহণ করার প্রভাব পড়েছে ভোক্তা বাজারে এবং তা বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়বে। বিশেষ করে আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে। এমনকি ভুগতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকেও।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এর প্রভাব পড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন জাপানের দাই-ইচি লাইফ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইয়োশিকি শিনকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, ‘বেশ কিছু সময় দুর্বলতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর চীনা অর্থনীতির হয়তো আবারও উত্থান ঘটবে। কিন্তু উৎপাদন কমে যাওয়ায় ফলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে।’

এশিয়ার দেশগুলোর এই অস্থির অবস্থা উত্তরণে আঞ্চলিক সহযোগিতা সবচেয়ে বড় উপায় হিসেবে হাজির হতে পারে। নইলে বিশ্বের বাকি অংশকে ভোগানোর পাশাপাশি এসব দেশের জনগণকেও দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে হবে।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন, মুডিস অ্যানালিটিকস ও সিএনএন

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন

যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ইতালির জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার টাইফুন

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত থামেনি, ট্রাম্প ‘থামিয়েছেন’ দাবি করা অন্য যুদ্ধগুলোর কী অবস্থা