করোনাভাইরাস মহামারির এই দুঃসময়ে গোটা বিশ্বকে আশার আলো দেখিয়েছে টিকা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে রেকর্ড সময়ের মধ্যে কোভিডের টিকা হাজির করেছেন। তাও এক-দুটি নয়। বেশ কয়েকটি। এর মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেই জরুরি ব্যবহারের অনুমতি মিলেছে সাতটি টিকার। এই টিকাগুলো বহু মানুষকে আশা দেখাচ্ছে। মজার বিষয় হলো কোভিড থেকে মুক্তির যে আশা সে দেখাচ্ছে, তা পূরণ হওয়া নিয়ে এখনো কিছুটা সংশয় থাকলেও এ নিয়ে করপোরেট আশাটি যে এরই মধ্যে পূরণ হয়ে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কোভিডের এই সময়ে এই টিকাগুলোর বেশ কয়েকটির নাম মানুষের মুখস্থ হয়ে গেছে। ফাইজার-বায়োএনটেক, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্ম, মডার্না বা স্পুতনিকের নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। এই টিকাগুলোরও আবার দেশ আছে। কোনোটি মার্কিন, কোনোটি চীনা আবার কোনোটি রুশ। ফলে অবধারিতভাবেই এই টিকার সঙ্গে জুড়িগাড়ি হয়ে ‘টিকা রাজনীতি’, ‘টিকা কূটনীতি’র মতো শব্দগুলো বেশ আলোচনা তৈরি করেছে। কিন্তু যার জন্য এই কূটনীতি বা রাজনীতি, সেই ব্যবসা সম্পর্কিত আলোচনাটি একটু আড়ালেই পড়ে গেছে।
বলা হচ্ছে, যে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিড টিকা তৈরি ও সরবরাহ করছে, তারা অতি মুনাফা না করলে মানুষ হয়তো পাঁচ ভাগের একভাগ দামে টিকা পেত। কিন্তু এত বড় একটি গ্রাহকগোষ্ঠীকে সামনে রেখে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা ছাড়তে তো চায়ইনি, বরং তা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এর ফল হয়েছে ভয়াবহ। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর অধিবাসীরা টিকা পেলেও বহু দরিদ্র দেশের মানুষ এখনো কোনো টিকাই পায়নি। বাংলাদেশেই কিছুদিন আগে টিকার সরবরাহ না থাকায় টিকাদান কর্মসূচি থেমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় বিশ্বের নানা প্রান্তের মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিলে দ্য পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স (পিভিএ) নামের একটি জোট করেছে, যেখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রয়েছে।
পিভিএ বলছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো যদি শুধু একচেটিয়া ব্যবসা করতে না চাইত, তাহলেই টিকার দাম অনেক কম পড়ত। কতটা? আগেই বলা হয়েছে পাঁচ-ভাগের এক ভাগ দাম।
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের একদল গবেষক এমআরএনএ টিকার সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়ের একটি হিসাব করেছে। তারা বলছে, ফাইজারের প্রতি ৮০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ৯৪০ কোটি ডলার হতে পারে। এই হিসাবে প্রতি ডোজ টিকার দাম ১ ডলার ১৮ সেন্টের আশপাশে হওয়ার কথা। একইভাবে মডার্নার টিকার সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়ের একটি হিসাব করা হয়েছে, যেখানে এর পরিমাণ ধরা হয়েছে ২ ডলার ৮৫ সেন্টের আশপাশে। অথচ দরিদ্র দেশগুলোর জন্য নেওয়া উদ্যোগ কোভ্যাক্সই এই টিকা কিনেছে ৫ ডলারের বেশি দামে।
সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়ের বিপরীতে বাজার থেকে কোম্পানিগুলো কত অর্থ তুলে নিচ্ছে, তা একটি হিসাব দেখলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। আফ্রিকা অঞ্চলে প্রতি ডোজ টিকার দাম সবচেয়ে কম নেয় ফাইজার-বায়োএনটেক। সেখানে প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়ে ৬ ডলার ৭৫ সেন্ট, যা ওই অঞ্চলের কোনো কোনো দেশের মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের সমান। কোম্পানিটি সবচেয়ে বেশি দাম নেয় ইসরায়েলে। সেখানে প্রতি ডোজ টিকা তারা বিক্রি করছে ২৮ ডলারে, যা সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়ের ২৪ গুণ। মডার্নার ক্ষেত্রেও টিকার দামে এই বিরাট তারতম্য দেখা যায়। একই কথা সিনোফার্মের ক্ষেত্রেও সত্য।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৮৩টি দেশে এখন পর্যন্ত ৪৯৮ কোটি ডোজ করোনা টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রতি দিন গড়ে ৩ কোটি ৬১ লাখ ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। পরিসংখ্যানটি বেশ সুন্দর হলেও বাস্তবতাটি সুন্দর নয়। এই টিকার অধিকাংশই পেয়েছে ধনী দেশগুলোর নাগরিকেরা। দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর তুলনায় ধনী দেশগুলোতে টিকা কার্যক্রম চলছে ২০ গুণ বেশি গতিতে।
এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনার পর ফাইজারের পক্ষ থেকে গেল মাসে জানানো হয়, তারা আফ্রিকায় ১০ কোটি ডোজ টিকা পাঠাচ্ছে। কিন্তু আফ্রিকার চাহিদার তুলনায় এই পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য।
এটা ঠিক যে, সারা বিশ্বে কোভিড টিকার যে চাহিদা তার জোগান দেওয়া কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। এই বাস্তবতা জগতের সবাই বুঝলেও টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বোঝেনি। টিকার প্রযুক্তি তারা কাউকে দেয়নি। এমনকি টিকা উৎপাদনের কোনো একটি ধাপও তারা কারও হাতে ছাড়তে নারাজ। অথচ শুধু এই কাজটি করলে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর মানুষ টিকা পেত অনেক সহজে ও কম খরচে। কিন্তু এমন ভয়াবহ দুর্যোগেও প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু নিজের মুনাফা নিয়েই ভেবেছে।
অথচ এই টিকা তৈরিতে ছিল সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ। সাধারণ মানুষের করের টাকায় হওয়া গবেষণার মাধ্যমেই টিকা আবিষ্কার ও এর উৎপাদন কৌশল হাতে এসেছিল ফাইজার ও মডার্নার মতো কোম্পানিগুলোর। মার্কিন জনগণের করের টাকা থেকে এ গবেষণায় বিনিয়োগ করা হয়েছিল ৮৩০ কোটি ডলার। অথচ যখন টিকা হাতে এল তাদের, তখন তারা একে বিরাট মুনাফার সম্ভাবনা হিসেবে দেখল। ভুলে গেল, এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটি তাদের হাতে আসলে সাধারণ মানুষই তুলে দিয়েছিল। এটা এতটাই যে, গোটা বিশ্বের সব দেশ যেন কোভিড টিকা পায়, সে জন্য গঠিত উদ্যোগ কোভ্যাক্সের কাছেও উৎপাদন ব্যয়ের পাঁচগুণ দামে তারা টিকা বিক্রি করল।
আছে আরও নানা কৌশল। টিকা পাসপোর্ট বা ভ্যাকসিন পাসপোর্ট বলে একটি নয়া টার্ম সামনে এল। এর মোদ্দা কথা হলো—করোনা সতর্কতা হিসেবে যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, তা একটি ভ্যাকসিন পাসপোর্ট থাকলেই উঠে যাবে। পাসপোর্ট বলতে টিকা গ্রহণের প্রমাণপত্র। শুরুতে বিষয়টি সরল-সোজাই ছিল। মুশকিল হলো যখন এই ভ্যাকসিন পাসপোর্টের পরিসরটি সংকুচিত হয়ে এল। পশ্চিমা দেশগুলো বলল, ফাইজারের টিকা না নেওয়া হলে সীমান্ত খুলবে না। গতকাল যখন মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকাকে পূর্ণ অনুমোদন দিল, তখন বুঝতে বাকি নেই যে, বাজারে এই টিকার দাম আরও বাড়বে। বাজার দখল বা বাজারে এলিট পণ্য হিসেবে নিজের জায়গা দখলের মাধ্যমে ফাইজার বা মডার্নার টিকা যে অবস্থান তৈরি করল, তা শুধু ধনী দেশগুলোরই নাগালে থাকল।
অথচ এই একচেটিয়া ব্যবসার প্রবণতা না থাকলে, গণমানুষের টাকায় তৈরি টিকা এত দিনে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশসহ সব দেশের মানুষের কাছে ঠিকই পৌঁছে যেত। কিন্তু শুধু অতি মুনাফার জেরে তা এখনো হয়নি। সবচেয়ে ভালোভাবেও যদি কর্মসূচিটি চালানো যায়, তাহলেও চলতি বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বের মাত্র ২৩ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় আসবে। বাংলাদেশ তো এখন তবু টিকা পাচ্ছে। আফ্রিকার বহু দেশ এখনো টিকার ভয়াবহ সংকটের মধ্যে রয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোর মানুষের ১ শতাংশেরও কম এখন পর্যন্ত টিকার আওতায় এসেছে। বিপরীতে মডার্না বা বায়োএনটেকের মতো কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীরা রাতারাতি হয়ে উঠেছেন শতকোটিপতি।
করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ব্যবসার একচেটিয়াকরণ করছে, তখন ধনী দেশগুলো কী করছে? তারা এই টিকা ব্যবসাকে গোটা বিশ্বে ছড়ি ঘোরানোর হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক নানা সমীকরণ এর ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এ ক্ষেত্রেও শত্রু-মিত্র প্রভেদ ঢুকে পড়েছে। নানা কৌশল খাটিয়ে বাধাগ্রস্ত করছে টিকা সরবরাহ ব্যবস্থা।
এখন অবশ্য ধনী দেশগুলো টিকা উপহার, অনুদান ইত্যাদি দিতে শুরু করেছে। তারা একে অন্যকে অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে উজ্জীবিত করছে। কিন্তু এটা শুধু মুদ্রার একটি মাত্র দিক। সব উপহার উপহার নয়। এর অনেক কিছুই টাকার অঙ্কে বিনিময় হয়, হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থনীতি, রাজনীতি ও কূটনীতির জটিল-কুটিল সব সমীকরণ। কোন দরিদ্র দেশের বাজার কার ভাগে যাবে বা কত ভাগ কে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার এক দারুণ হিসাব চলছে সবার অজ্ঞাতে। কম মূল্যে টিকা দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দিয়েছিলেন, তার প্রতিবাদ কতগুলো স্থান থেকে কে কে করেছে তার উল্লেখ এখানে না করলেও চলে। বোঝাই যাচ্ছে, ভবিষ্যতে এই টিকা ব্যবসা আরও প্রকট ও ন্যাংটো হয়ে সামনে আসবে।
মজার বিষয় হলো, আগে থেকেই চাহিদা তৈরি হয়ে আছে এমন বাজারে কোনো একটি নতুন পণ্য এলে সাধারণত এর দাম বেশি থাকে। পরে অন্য প্রতিযোগী পণ্য এসে হাজির হলে বাজারের সাধারণ নিয়ম মেনেই এ দাম কমতে থাকে। কিন্তু কোভিড টিকার ক্ষেত্রে এমনটি দেখা যাচ্ছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দ্বিতীয় কিস্তিতে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা কেনার সময় প্রথমবারের চেয়ে বেশি দাম পরিশোধ করেছে। আরও মজার বিষয় হলো, বুস্টার ডোজ নিয়ে। বলা হচ্ছে, টিকাকে শরীরে কার্যকর রাখতে হলে বুস্টার নিতে হবে। কত দিন? এখনো অজানা এর উত্তর। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ফাইজার এখনই জানিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতে তাদের টিকার দাম আরও বাড়তে পারে। কতটা? প্রতি ডোজ ১৭৫ ডলার পর্যন্ত পড়তে পারে। অর্থাৎ, সম্ভাব্য উৎপাদন ব্যয়ের ১৪৮ গুণ বেশি দামে এই টিকা কিনতে হতে পারে। সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ধনী দেশগুলোর সরকার এই টিকায় ভর্তুকি দিতে পারে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোর কী হবে? সেখানে কি মানুষ বাঁচবে না বা বাঁচতে চায় না?