হোম > বিশ্লেষণ

ইরান কেন তার সবচেয়ে মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের সুরক্ষায় বারবার ব্যর্থ

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

শুক্রবারের ইসরায়েলি হামলায় ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ছবি: এএফপি

ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীরা এক অদৃশ্য আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছেন। গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একের পর এক বিজ্ঞানী রহস্যজনক হামলা বা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে ইরান। এ ঘটনাগুলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে ব্যাহত করার পাশাপাশি দেশটির নিরাপত্তাব্যবস্থাকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

কেন ইরান তার সবচেয়ে মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে? অনুমান করা হয়, এর পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক গুপ্তচরবৃত্তির এক জটিল জাল।

এ পর্যন্ত নিহত ইরানি পরামণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে আছেন:

২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৬ জন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন—

১. আর্দেশির হোসেইনপুর (২০০৭): রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মারা যান। আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাস বিষক্রিয়া বলা হলেও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের বিকিরণ বিষক্রিয়া অথবা পরমাণু কর্মসূচিতে কাজ করতে অস্বীকার করায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) তাঁকে হত্যা করে বলে সন্দেহ করা হয়।

২. মাসুদ আলী-মোহাম্মদী (২০১০) : তেহরানে একটি মোটরসাইকেলে রাখা রিমোট-কন্ট্রোলড বোমায় নিহত হন।

৩. মাজিদ শাহরিয়ারি (২০১০) : তেহরানে তাঁর গাড়িতে লাগানো একটি ম্যাগনেটিক বোমার বিস্ফোরণে নিহত হন।

৪. দারিউশ রেজাইনেজাদ (২০১১) : তেহরানে মোটরসাইকেল আরোহী বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন।

৫. মোস্তফা আহমাদি রোশান (২০১২) : তেহরানে তাঁর গাড়িতে লাগানো একটি ম্যাগনেটিক বোমায় নিহত হন।

৬. মোহসেন ফাখরিজাদেহ (২০২০) : তেহরানের কাছে একটি রাস্তার পাশে অতর্কিত হামলায় রিমোট-কন্ট্রোলড মেশিনগান ব্যবহার করে হত্যা করা হয়।

৭. ফেরেইদুন আব্বাসি (২০১০) : তেহরানে একটি গাড়িবোমা হামলা থেকে বেঁচে যান।

শুক্রবার ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন:

১. সাঈদ বোরজি: পরমাণু কর্মসূচির (এসপিএনডি) বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ; মোহসেন ফাখরিজাদেহের সরাসরি অধীনে কাজ করতেন; ২০১৯ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

২. আকবর মোতালেবিজাদেহ: এসপিএনডির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ; ২০১৯ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

৩. মানসুর আসগারি: এসপিএনডির গবেষণা ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান; ২০১৯ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

৪. আহমদ হাগিগাত তালাব: এসপিএনডির সিনিয়র কর্মকর্তা; ২০২৫ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

৫. আমির হোসেইন ফেকহি: শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু অধ্যাপক।

৬. আব্দুল হামিদ মানুচেহর: শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান।

৭. সায়েদ মোহাম্মদ রেজা সিদ্দিকী সাবের: এসপিএনডির প্রধান; ২০২৫ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত।

৮. আহমদ রেজা জুলফাগারি: শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যাপক।

৯. আলী বাকোই কাত্রিমি: তারবিয়াত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমিক মলিকুলার ফিজিক্সের অধ্যাপক।

তবে ইরান এখন পর্যন্ত ছয়জন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে।

পশ্চিমা আপত্তির মুখে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসারায়েলের জন্য সরাসরি হুমকি হয়ে থাকা ইরান পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে নিতে বাধার সম্মুখীন হবে, এটি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এসব জেনেও ইরান কেন তার সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে? এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে:

১. বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার অত্যাধুনিক অপারেশন

ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে বলে জোর সন্দেহ রয়েছে। তাদের অপারেশনগুলো এতটাই চৌকশ যে ইরান প্রায়শই তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। রিমোট-কন্ট্রোলড অস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত মেশিনগান এবং স্থানীয় সহযোগীদের ব্যবহার করে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২০ সালে শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যার ঘটনায় একটি স্যাটেলাইট-নিয়ন্ত্রিত মেশিনগান ব্যবহার করা হয়েছিল। এই অস্ত্র টুকরো টুকরো করে ইরানে পাচার করা হয়েছিল। এটি হামলাকারীদের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বকেই তুলে ধরে।

২. অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা দুর্বলতা

ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী, বিশেষ করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), উচ্চ-পর্যায়ের লক্ষ্যবস্তু সুরক্ষায় ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত। অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস এবং ইরানের নিরাপত্তা বা সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সম্ভাব্য অনুপ্রবেশকারীদের অস্তিত্বকে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০২১ সালে, ইরানের গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রী দাবি করেন, ফাখরিজাদেহর হত্যাকাণ্ডে সশস্ত্র বাহিনীর একজন সদস্য জড়িত ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় ইরানে এই সমালোচনাও দেখা যায়, সরকার অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নে বেশি মনোযোগী, পাল্টা গোয়েন্দা কার্যক্রমে নয়।

৩. সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্বাচন ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

ঘাতকেরা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীদের খুব সাবধানে নির্বাচন করে। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে কর্মসূচির অগ্রগতি ব্যাহত করা এবং অন্যদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা। এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ব্যাপক। বিশেষজ্ঞরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘ধ্রুপদি সন্ত্রাসী কৌশল’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে শত্রুর এই বিজয় ইরানের তার কর্মীদের সুরক্ষায় অক্ষমতাই প্রকাশ করে। ফাখরিজাদেহর মতো একজন উচ্চ প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানীকে প্রতিস্থাপন করতে ছয় বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে অনুমান করা হয়, যা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

৪. ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সীমিত পাল্টা ব্যবস্থার বিকল্প

ইরানের প্রতিপক্ষ, বিশেষত ইসরায়েল, তার সামরিক ও গোয়েন্দা শ্রেষ্ঠত্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মিত্রদের সমর্থনের কারণে তুলনামূলক দায়মুক্তভাবেই কাজ করে। তারা চাইলেই ইরানের ভূখণ্ডের বাইরে এমনকি বিদেশের মাটিতেও ইরানিদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা চালায়। কিন্তু ইরান প্রায়শই পূর্ণাঙ্গ সংঘাত এড়াতে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই অসম পরিস্থিতি মূলত ইরানের বরং ভবিষ্যতের আক্রমণ প্রতিরোধ করার সক্ষমতাকে সীমিত করে। ২০১৩ সালে, পরমাণু আলোচনা চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইসরায়েলের এই গুপ্তহত্যা অভিযান স্থগিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এই অগ্রগতি ইঙ্গিত করে, বাহ্যিক কূটনৈতিক গতিশীলতাও ইরানের দুর্বলতাকে প্রভাবিত করে।

৫. আতঙ্ক এবং সম্পদ বিচ্যুতি

এই ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডগুলো ইরানকে সব সময় চাপে রেখেছে। বিজ্ঞানীদের সুরক্ষা দিতে এবং নাশকতার সম্ভাব্য সরঞ্জাম যাচাই করতে উল্লেখযোগ্য ব্যয় বরাদ্দে বাধ্য হয়েছে। বলতে গেলে, বিজ্ঞানীদের সুরক্ষায় অর্থ, সময় ও মেধা বিনিয়োগ করতে গিয়ে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গতি ধীর হয়েছে। এই সাক্ষাৎ আতঙ্ক, ইরানের নিরাপত্তা সক্ষমতার ওপর আরও চাপ তৈরি করেছে। ফলে কখনোই তারা নির্দিষ্ট কর্মসূচিতে মনোযোগ নিবিষ্ট করতে পারেনি।

ইরান ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলকে এবং কখনো কখনো যুক্তরাষ্ট্রকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে থাকে। যদিও ইসরায়েল প্রায়ই এ ব্যাপারে নীরব থাকে। স্বীকার বা অস্বীকারও করে কখনো কখনো।

এই হত্যাকাণ্ডগুলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে থামিয়ে দিতে পারেনি, কিন্তু অগ্রগতি যে বিঘ্নিত হয়েছে এবং বারবার তাদের নিরাপত্তা দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার, ইরানের এই ব্যর্থতাকে বহিঃশক্তির অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশলগত সক্ষমতা এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার নিদর্শন বলে মনে করে অনেকে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মূলত পশ্চিমা ও ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গেই মিলে যায়। তারা ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সীমাবদ্ধ করার জন্য এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘প্রয়োজনীয়’ বলে অভিহিত করে। ইরান যদিও তার পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে। এই হত্যাকাণ্ডগুলোর নৈতিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক পরিচালক জন ব্রেনানের মতো ব্যক্তিরা এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘অপরাধমূলক’ এবং ‘বেপরোয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।

আরও খবর পড়ুন:

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন