গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির উদ্বোধন করা হয় ২০ আগস্ট, বুধবার। এরপর ঘটে ম্যাজিক কারবার। বৃহস্পতিবার এই সেতুর ল্যাম্পপোস্টের বিদ্যুৎ সরবরাহের তার বেমালুম চুরি হয়ে যায়। এরপর যা হয়, তাই হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার উপভোগ হয়তো করা যাবে, কোনো হরর ফিল্মের মতো কোনো ঘটনা হয়তো ঘটানো যাবে, কিন্তু হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে সেতুটি উজ্জ্বল করে তোলা যাবে না। চোরেরা বড় সেয়ানা। ভাসানী সেতুটিকে খুবই সুচারুভাবে তারা বিদ্যুৎহীন করে দিয়েছে।
শিগগিরই হয়তো বিদ্যুতের তারগুলো এসে আলোকিত করে তুলবে সেতুটি। আমরা সে ব্যাপারে যাচ্ছি না। আলোকিত করাই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য। সেটা করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানসিকতার। সেতু হলে জনজীবনে স্বস্তি আসে। এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যোগাযোগে গতির সঞ্চার হয়। কিন্তু চোরেরা যদি নির্বিঘ্নে তাদের চৌর্যবৃত্তি চালিয়ে যেতে থাকে, তাহলে সেই উন্নতির মধ্যে গলদ থেকেই যায়। আমাদের উন্নয়নের পথটিকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলছে এই মানসিকতা। কোন রাজার আমল, সেটা প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হলো, সব আমলেই চোরেরা তাদের কর্মকাণ্ড ছোট-বড় নানা পরিসরে ঘটিয়ে চলেছে। জনগণ ‘পাবলিক’ হয়ে এসব দেখেই যাচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে।
কবে কখন আমাদের দেশে এতটা নৈতিক অবক্ষয় ঘটে গেল, তা নিয়ে ভাবতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থ যখন সামাজিক স্বার্থের ওপরে উঠে আসে, কাজের চেয়ে চুরির প্রতি যখন আকর্ষণ বাড়ে, তখন যে উন্নয়ন হয়, তা টিকে থাকে না। এরা বোঝেও না, রাষ্ট্রের সম্পদ আসলে নিজেরই সম্পদ। বোঝে না, এই সম্পদ টিকিয়ে রাখতে পারলেই সমবেতভাবে এগিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু কে কার কথা শোনে?
শুধু ব্যাংক লুণ্ঠন, ঠিকাদারি, বদলি-বাণিজ্যের মধ্যেই কি টিকে আছে দুর্নীতিবাজেরা? এ প্রশ্নের উত্তর সবাই জানে। এই চোরেরা ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’ মতবাদে বিশ্বাসী। যেকোনো ধরনের উন্নয়নই এখানে ছাই, আর সেই ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসা চুরি হচ্ছে ‘অমূল্য রতন’। নাগরিক সেবা বিষয়টিই চুরির কাছে আত্মসমর্পণ করছে কি না, তা নিয়েও ভাবতে হবে।
সেতুর তার চুরিসহ অন্যান্য চুরি ঠেকাতে পুলিশ মোতায়েন করা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। কেমন এক সমাজ গড়ে তোলা হলো, যেখানে বিদ্যুতের তারও চোরদের কাছ থেকে নিরাপদ নয়? তাহলে কি প্রতিটি সেতুকে রক্ষা করতে পুলিশ মোতায়েন করতে হবে?
আসলে নাগরিক সচেতনতা, দায়িত্ববোধ আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। তবে সবার আগে রাষ্ট্রের সম্পদ আর ব্যক্তিগত সম্পদের পার্থক্যটা হৃদয়ঙ্গম করা দরকার। নইলে চোরেরা তাদের শিল্পকর্ম চালিয়ে যেতেই থাকবে। এরই প্রতিকার দরকার। নৈতিকতাহীন সমাজকে সুপথে আনতে না পারলে যা হয়, তা-ই বিপজ্জনক। এই বিপদেই থাকবে মানুষ, নাকি বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারবে, সেটাই আমাদের জিজ্ঞাসা।