অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান অধ্যাপক ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের একটি আবহ তৈরি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী আর এনসিপি জুলাই সনদের ব্যাপারে একটা ফয়সালা না হলে নির্বাচনে যাবে না, এ রকম যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের দিনই গণভোট হবে—এটাও মেনে নিয়েছে ভোটের আগে গণভোটের দাবিদারেরা। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে বর্তমানে আলোচনায় থাকা দলগুলোর সবার জন্যই কিছু না কিছু ছিল। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করলেও দলীয় আলোচনার পর প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছে দলগুলো। আশা করা যাচ্ছে, দেশ এখন নির্বাচনের মহাসড়কে উঠতে পারে।
মুশকিল হলো, যে ঐক্যের জন্য এত কিছু করা হলো, সেই ঐক্যের কি দেখা মিলছে? বিভক্ত জাতিকে এক মোহনায় মেলানোর যে অঙ্গীকার ছিল, সে অঙ্গীকার পালন করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। হিংসা, অবিশ্বাস, পেশিশক্তি, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্বসহ চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা অনিয়ম দূর করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একটি ভালো নির্বাচন হলে ধীরে ধীরে একটা শৃঙ্খলার দিকে এগোবে দেশ—এ রকম আশা অনেকের। কিন্তু শুধু একটি নির্বাচনই সবকিছু জায়গামতো নিয়ে আসতে পারে না, যদি না ভালো কিছু করার সদিচ্ছা থাকে। নির্বাচিত দলকে ভালো কাজে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সহায়তা করা, বিরোধী দলের মতামতকে সরকারি দলের গুরুত্ব দেওয়া—এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের ব্যর্থতাকে অন্যের ব্যর্থতা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হিতে বিপরীত হবে। গত বছরের আগস্ট মাসের পর থেকে নানা ধরনের ঘটনায় মনে হয়েছে, এই অস্থিরতা সামাল দিতে না পারলে সংস্কার, নির্বাচন—কোনো কিছুই জনমনে স্বস্তি দেবে না। এদিকে নজর দেওয়া দরকার।
নতুন যুগে দেয়াললিখনের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির গুরুত্ব বেশি। এমনকি প্রতিষ্ঠিত প্রচারমাধ্যমের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। ফলে, দেয়াললিখনের জায়গায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ কী বলছে, সেদিকেও চোখ রাখা জরুরি। জরুরি রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ কী বলছে, তা শোনা। এই বার্তা কানের মাধ্যমে মনে পৌঁছালেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।
সরকার পরিচালনা করবে বিজয়ী দল। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার পরেই সে দল দেশের সকল মানুষের প্রতিনিধি হিসেবেই দেশ পরিচালনা করবে। সুতরাং দেশের সকল মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে তাদের যোগ থাকতে হবে। সমুন্নত রাখতে হবে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব। আমাদের জাতির ইতিহাস কীভাবে রচিত হয়েছে, তার তথ্য-উপাত্ত লিপিবদ্ধ আছে। কালের স্রোত কীভাবে আমাদের জাতিকে স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল, কোন আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য জাতি ছিল অঙ্গীকারবদ্ধ, সে কথাগুলো নতুন করে ভাবা দরকার। জাতিরাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত দল আন্তরিক হবে, সেটাই কাম্য। তবে সবার আগে দরকার একটি সুষ্ঠু, প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন, সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।