হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

হতাশায় পথ খোঁজা: ভাষা ও সংস্কৃতি

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

ফাইল ছবি

আটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি এক মুখ্য গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্লোগানগুলো ছিল কখনো গানের ভাষায়, কখনো রাজপথের রুদ্র বাক্যে—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ অথবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কৃষক লাঙল চালাতে চালাতে থমকে দাঁড়ায়, ‘কী ব্যাপার, মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়?’ শীতের কাঁথা গায়ে কোনো অশীতিপর বৃদ্ধও কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে ‘কারা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়?’ ছাত্রদের প্রশ্ন, ‘কী চায় ওরা? সেই দিন রাষ্ট্রটা জন্ম নিল, তাহলে কাইড়া নেওয়ার প্রশ্নটা উঠল ক্যান? ওরা-আমরা তাইলে এক না?’

অসংখ্য প্রশ্নের জবাব মেলে না। তাই ছাত্র-জনতার প্রতিবাদের ঝড়টা এসে দাঁড়ায় রাজপথে। রাজপথ রঞ্জিত হয় রক্তে। তখনকার গণপরিষদ কেঁপে উঠল। শুধু শাসকগোষ্ঠী ছাড়া সবাই এক কাতারে। হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে বাঙালি জাতির দৃশ্যমান একটা গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল, যদিও রক্তাক্ত। বিদেশি এবং দেশি শাসকগোষ্ঠী সব সময়ই এই সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেছে। পাকিস্তান আমলেও এই সংস্কৃতিকে মেনে নিতে পারেনি। কারণে-অকারণে আঘাত করেছে কিন্তু জাতি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শাসকেরা শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে নিয়েছে। জাতিকে মিলিটারির বুটের তলায় রাখার চেষ্টা করেছে। তার পরিণতিও সুখের হয়নি। একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের স্মারক হিসেবে জন্ম নিয়েছে বাংলা একাডেমি ও পরবর্তীকালে আরেকটি প্রতিষ্ঠান বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলা একাডেমির কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিল্পকলা একাডেমি এবং পাশাপাশি উপজাতীয় কালচারাল একাডেমি। কথা ছিল এ সবই হবে স্বায়ত্তশাসিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্য হবেন দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও মেধাবী ব্যক্তিরা। তাঁরাই নির্ধারণ করবেন নীতিনির্ধারকদের। বাংলা একাডেমির সদস্যরা কিছু কিছু সময় ভোটের মাধ্যমে একটি নীতিনির্ধারক কমিটি নির্বাচিত করলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পকলা একাডেমি চলতে থাকে জেলা প্রশাসকদের প্রধান করে। মন্ত্রণালয় মনোনীত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে কমিটিগুলো। সব ক্ষমতার উৎস গিয়ে দাঁড়ায় মন্ত্রণালয়।

মহাপরিচালকেরা যেহেতু দলীয় বিবেচনায় নিয়োজিত, তাই তাঁদের কাজই হচ্ছে মন্ত্রণালয়কে সন্তুষ্ট রাখা এবং দিনের একটা সময় ফাইল বগলে করে সচিবালয় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে নিজের অফিসে ফেরা। দু-চারটে ব্যতিক্রম ছাড়া সব সময়ই একাডেমির প্রকাশনা, পুরস্কার এসবে নিয়োগদাতাদের সন্তুষ্ট করা। শিল্পকলা একাডেমির কর্মকাণ্ড নির্ভর করে খোদ শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশেই। যে মহাপরিচালক যত বেশি নতজানু, তাঁর সময়ই বেশি কর্মকাণ্ড এবং অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। যদিও ভবিষ্যতে জাতির সংস্কৃতিতে তা যুক্ত হয় না। অনেক দিন ধরেই লক্ষ করা গেছে বাংলা একাডেমির পুরস্কারে প্রবল পক্ষপাতিত্ব। দলীয় আশীর্বাদ ছাড়া দু-একটি ক্ষেত্রে হয়তো সঠিক ব্যক্তির ভাগ্যে এই পুরস্কার লাভের সুযোগ হয়েছে। তবে যতটা মনে পড়ে, পাকিস্তান আমলে পুরস্কারগুলো সঠিকই হয়েছে। কারণ, এর ওপর সরকারের খুব একটা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সম্ভবত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও তখন ছিল না।

পৃথিবীর অনেক দেশেই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই। সংস্কৃতি সেখানে শিক্ষার আওতাভুক্ত। যুক্তিটা হচ্ছে, মন্ত্রণালয় থাকলেই সেখানে একটা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন এসে যায়, বাংলাদেশ তার একটি অন্যতম উদাহরণ। বাংলা একাডেমি ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যে পদকগুলো দিয়ে থাকে, তা-ও দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে নয়। পুরস্কার গ্রহণ এবং পুরস্কার প্রত্যাখ্যান, দুটিরই ঐতিহ্য আছে। ১৯৮৩ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এবং গোলাম মুরশিদ পুরস্কৃত হন, সেই সঙ্গে আমিও। কিন্তু দুটি কারণে সেই পুরস্কার আমি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। এর পরের বছরগুলোতেও গণতান্ত্রিক সরকার না আসা পর্যন্ত এই পুরস্কারটির দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে তা নিরপেক্ষ ছিল।

যাই হোক, পুরস্কার দেওয়া ছাড়াও এইসব প্রতিষ্ঠানের আরও অনেক কাজ আছে। প্রত্যেকেরই গবেষণা, প্রকাশনা এবং নানা সময়ে অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে। আর বাংলা একাডেমির সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হচ্ছে একুশের বইমেলা। বইমেলায় প্রতিদিনই আলোচনা অনুষ্ঠান থাকে। কেউ যদি গবেষণা করতে চান তাহলে দেখবেন এখানে যাঁরা আলোচক, সভাপতি বা মূল প্রবন্ধ পাঠ করেছেন, দু-চারজন ব্যতীত সবারই একধরনের রাজনৈতিক পরিচিতি আছে। এসব কথা বলার অর্থ হচ্ছে গণতন্ত্রের অন্যতম মূলমন্ত্র যোগ্য লোক, যোগ্য দল, যোগ্য গোষ্ঠী সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। সেই লোক বা গোষ্ঠীকে খুঁজতে গেলে মাথায় যদি নিরপেক্ষতার বদলে দলীয় বিবেচনা বা শাসকগোষ্ঠীর অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো এসে যায়, তাহলে গণতন্ত্রকে আমরা কোথায় খুঁজে পাব?

আমরা যত কথাই বলি না কেন, আসলে সংস্কৃতি রাজনীতিকে পথ দেখায়। মানুষের চিন্তার গভীরে সংস্কৃতিই বসবাস করে। সেখান থেকেই সব সিদ্ধান্ত উৎসারিত হয়। কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা নিজের মনোনীত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার অধিকার যখন ক্ষুণ্ন বা বিঘ্নিত হয়, তখন অন্য ধরনের চিন্তা মানুষের মনে উদ্রেক হতে থাকে। তার একটি হচ্ছে পেশিশক্তি, জবরদখল অথবা নানা ধরনের বিকৃতি। সেই বিকৃতির পথে অনেক দিন ধরে চলছে বাংলাদেশ। রাজনীতিতে বিকৃতি এসেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় এসেছে। মানবিক যেসব বিষয় মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে তাতেও এসেছে। নির্বাচিত প্রতিনিধি সব মানুষের প্রতিনিধি নয়। শিক্ষক সব ছাত্রের নয়। মুষ্টিমেয় কোচিংয়ের অধীনে যারা ছাত্র তারাই শিক্ষকের প্রিয়। শিক্ষাব্যবস্থায় নিম্নবিত্তের কোনো অধিকারই নেই। প্রাইমারি স্কুলগুলোতে বিনা মূল্যে পাঠদান করানো হয়, উপবৃত্তির ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু সেখানেও ছাত্ররা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, বড় ধরনের বৈষম্য আছে সেখানে। আর এই বৈষম্য সৃষ্টি করেছে অর্থ। প্রাইভেট পড়াটা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। শিক্ষক যখন ছাত্রকে দুই রকম দৃষ্টিতে দেখেন, তখন ছাত্রের কাছে আর শিক্ষাটা প্রিয় হয়ে ওঠে না।

দেশভাগের পর শিক্ষকেরা বহুদিন বেতন পাননি। যদিও বেতন ছিল খুব সামান্য। তবু অধিকাংশ স্কুল চলেছে শিক্ষকদের সততা এবং অঙ্গীকারের কারণে। আমি যে স্কুলে পড়েছি, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সেখানে প্রধান শিক্ষকের বেতন ছিল চল্লিশ টাকা। সেই টাকাও তিনি একসঙ্গে পেতেন না, সহকারী শিক্ষকেরা বেতন পেতেন পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকা। এতে তাঁদের সংসার চলত না, কারণ একবারে বেতনটা পেতেন না। তাঁরা প্রাইভেট টিউশনিও করতেন না। এই টাকা থেকেই তাঁরা দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। স্কুলের নানা আনুষ্ঠানিকতায় তাঁরা চাঁদাও দিতেন। ফলে শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি আবেগ তৈরি হতো। এই শিক্ষকেরা যেকোনো আদর্শগত সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করতেন। ভাষা আন্দোলন ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রত্যক্ষ প্রভাবে তাদের জীবনচর্চা চলত।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে যে মৌল আদর্শগুলো পরবর্তীকালে আমাদের সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল, এ সবই ওই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা—এ সবই সেই সময়কার শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে এসেছে। বহু দিন পর্যন্ত এই প্রভাব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছিল। কিন্তু যখনই অসাম্প্রদায়িক জায়গাটা ধসে পড়তে শুরু করল, তখন থেকেই অপসংস্কৃতির জোয়ার বাংলার সংস্কৃতিকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। বর্তমানে আনুষ্ঠানিকতা আছে কিন্তু মূল বিষয়গুলো ধীরে ধীরে হারিয়েও গেছে। যার ফলাফল আমরা প্রায় প্রতিদিনই দেখতে পাই। কি রকম একটা জায়গা থেকে আমাদের সংস্কৃতি এবং রাজনীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল, যার ফলে আমরা একটি জাতি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পেরেছিলাম! সেই জাতি রাষ্ট্রের মূলকাঠামোর মধ্যে সংস্কৃতির যে জায়গাটা ছিল, তাকে কলুষিত করতে করতে আমরা একটা পরমুখাপেক্ষী সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করছি।

আমাদের সংস্কৃতির আরও একটি বড় জায়গা ছিল, সেটি হচ্ছে নৈতিকতাবোধ। আজকের দুর্নীতিপরায়ণ সমাজের দিকে তাকালে সেই বোধটা বারবার শুধু হোঁচট খায় না, আহত হয়। আজকের দিনে ব্যাপক মানুষের হতাশা নিয়ে একটা সমাজ সামনের দিকে এগোতে পারছে না। কিন্তু মানবের ধর্ম সামনের দিকে এগোয়। সামনে যাওয়ার সেই পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি