হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

কর আহরণ ও কর প্রদান: বিবেচনার কয়েকটি বিষয় 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের আওতায় করারোপ, আর রাষ্ট্রকে সেই কর পরিশোধের বিষয়টি এ নিরিখে বিচার করলে দেখা যায় আদায় শব্দটা ততটা জুতসই, নয় যতটা ভূমিকর বা খাজনার ক্ষেত্রে খাটে। আয়করের দর্শন হলো রাষ্ট্রে বসবাস করে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি আয়, বা সম্পদ অর্জিত হলে রাষ্ট্র তার একটা নির্দিষ্ট অংশ ‘সমাজে সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা বিধান এবং আয় উপার্জনের পরিবেশ সৃজন, তথা অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ আয় উপার্জনের পরিমাণভেদে একটা হিস্যা’ প্রাপ্য হিসেবে চাইতে পারে। ভূমিকরের ক্ষেত্রে আগে রাষ্ট্র ভূমি বরাদ্দ দেয় এবং তার ভিত্তিতে খাজনা দাবি করে এখানে লেনদেন প্রকাশ্য, সুতরাং দাবি বা আদায়ের যৌক্তিকতা সেভাবে আসে। কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে লেনদেন অপ্রকাশ্য, রাষ্ট্র সৃজিত সুযোগ-সুবিধা সবাই ভোগ করলেও সবাই আয় বা সম্পদ অর্জন করতে পারে না। নিজের মেধা, বুদ্ধি, পরিশ্রম প্রয়োগ করে সম্পদ অর্জন করতে হয়। অতএব সেই আয়ের ওপর রাষ্ট্রের যে দাবি, তা নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে প্রদেয়। এখানে রাষ্ট্রের পক্ষে তা ‘আদায়ের’ যৌক্তিকতা অনেকটা গৌণ। 

আয়কর দেওয়ার মতো আয় যে নাগরিকের আছে, তিনি রাষ্ট্রকে দেয় কর পরিশোধ করবেন স্বেচ্ছায়, আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করে নাগরিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। তবে হ্যাঁ, যদি তিনি তা পরিশোধে গড়িমসি করেন, এড়িয়ে চলেন, অসাধু পন্থা অবলম্বন করেন, তাহলে আইনের আওতায় রাষ্ট্রের প্রাপ্য উদ্ধারে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। কেউ কর ফাঁকি দিলে তা উদ্ধারে ব্যর্থতার দায় আহরণকারীর। কারণ, তাদের এ অপারগতায় সমাজে ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ অসম অবস্থানে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে তো বটেই, সমাজে সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে, যা সমাজ ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। 

এ নিরিখেই সব করদাতার সঙ্গে ‘আদায়’-জনিত মনোভাব পোষণ বা ক্ষমতার প্রয়োগ বা সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। সীমারেখা মেনে চলা জরুরি এ জন্য যে, তা না হলে কর আরোপ, আহরণ, প্রদান ও পরিশোধের ক্ষেত্রে ভিন্ন নেতিবাচক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। করারোপ ও আহরণকারীর সঙ্গে করদাতার সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ দানা বাঁধতে পারে, আস্থায় চিড় ধরতে পারে, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার, জোর জবরদস্তির, পক্ষপাত বা আঁতাতের মতো অভিযোগ উঠতে পারে। স্বচ্ছতার স্থলে অস্বচ্ছতার অনুপ্রবেশে কর আহরণের মতো রাজস্ব আয়ের ব্যবস্থায় ‘সিস্টেম লস’ বা অনানুষ্ঠানিক আয়ের মতো ‘সুগারের’ মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, যা অর্থনীতিকে ‘ডায়াবেটিস’ আক্রান্ত করতে পারে। কে না জানে ‘সাইলেন্ট কিলার’ নামে পরিচিত যে রোগ দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক। 

জাতীয় আয়কর মাস বা দিবস উদ্‌যাপনকালে এটা জানা বেশ প্রশান্তিদায়ক যে, সরকারের অন্য খাতের বা ক্ষেত্রের চাইতে রাজস্ব, বিশেষত আয়কর আহরণে অগ্রগতি অব্যাহত আছে উৎসাহব্যঞ্জকভাবেই। আয়কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি, তথা করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনে প্রক্রিয়াগত পরিবর্তন আনার প্রয়াসের ফসল থেকেই এ সাফল্য আসছে। এটি ধরে রাখতে হবে অর্থনীতিতে কর-জিডিপি অনুপাত ন্যায্য পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত। বাঞ্ছিত পরিমাণ আয়কর আহরণ সরকারের রাজস্ব তহবিলের স্ফীতির জন্য নয় শুধু, সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা সুষমকরণের দ্বারা সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিতকরণে, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও অঞ্চলগত উন্নয়ন-বৈষম্য দূর করতেও জরুরি। দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার গৌরবে গড়তে ও পরনির্ভরতার নিগড় থেকে বের করে আনতে আয়কর অন্যতম প্রভাবক ভূমিকা পালন করবে। আয়কর বিভাগের প্রতিটি প্রয়াসে তাই থাকা চাই বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সম্মিলন। 

২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রচলিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে কর রাজস্ব আহরণের সাফল্য লাভের পর আর পেছনে তাকাতে হয়নি এনবিআরকে। পরের চার অর্থবছরে সার্বিক রাজস্ব আয় প্রায় শতভাগ বেড়েছিল। আয়কর রাজস্ব বৃদ্ধির পেছনে এডিপির আকার বৃদ্ধিজনিত প্রবৃদ্ধিও সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। এডিপির বাস্তবায়ন বৃদ্ধির সঙ্গে স্থিরিকৃত আয়কর অধিক পরিমাণে আহরণের একটা অবারিত সুযোগ ও সম্পর্ক আছে। দেখা যাচ্ছে এ চার অর্থবছরে কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত করের অনুপাত ৫৯: ৪১ থেকে ৫৫: ৪৫-এ উন্নীত হয়েছে। আর সার্বিক কর রাজস্বে আয়করের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০-এর কাছাকাছি। তবে বলে রাখা ভালো এখনো আয়কর মোট কর-রাজস্ব প্রাপ্তির তৃতীয় শরিক। অর্থনীতির আকার ও চরিত্র অনুযায়ী আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করকে (মূসক) টপকে আয়করের অবস্থান এক নম্বর হওয়া বাঞ্ছনীয়, নয় কি? সার্বিক রাজস্ব আয়ে আমদানি শুল্কের হিস্যা এখনো ৩৭ ও মূসকের ৩৫ শতাংশ। আয়করকে মোড়লিপনায় আসতে হলে আরও জোরে চলতে হবে, চাই অধিকতর সমন্বিত উদ্যোগ। 

নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি পুরোনো উদ্যোগের সালতামামি বা ফলোআপ-আপ আবশ্যক। ২০০৬-০৭ সালে জমকালো জরিপের মাধ্যমে যে লক্ষাধিক করদাতা শামিল হয়েছিলেন, করদাতার মিছিলে তাঁরা কি আছেন? ২০০৭-০৮ কিংবা ২০০৮-০৯ এ যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করদাতা হয়েছিলেন, তাঁদের খবর কি? দেশে যে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক ক্রেডিট কার্ডধারী আছেন, আছেন প্রায় সমসংখ্যক গাড়ি-বাড়ির মালিক, তাঁদের কাছে যাওয়ার সর্বশেষ অবস্থা কি? ভুয়া টিআইএন ব্যবহারকারীদের সঠিক পথে আনার প্রতিবন্ধকতাগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি। 

আয়করদাতা যাতে নিজেই রিটার্ন ফরম পূরণ করতে পারেন, সে ব্যাপারে যে সহায়ক নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছিল, প্রচারিত হয়েছিল সিটিজেন চার্টার, তা কি গণ-অবিহিতকরণের অবয়বে আছে এখনো। আগেও যেসব কর তথ্যকেন্দ্র, সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছিল প্রকল্পের প্রেরণায় সেগুলোর কার্যকারিতা থেমে গেছে কিনা, তা দেখার অবকাশ রয়েছে। একই কার্যক্রম বারবার ‘নতুন’ করে চালু করলে ভিন্ন বার্তা পৌঁছাতে পারে টার্গেট গ্রুপের কাছে। কর মেলায় মানুষের উপচে পড়া ভিড় প্রমাণ করে করদাতাদের আগ্রহ বাড়ছে, অনেকেই ঝামেলামুক্ত উপায়ে বা পরিবেশে কর দিতে চান, কর দেওয়াকে দায়িত্ব মনে করছেন, তাঁদের এই আগ্রহকে ধরে রাখতে হবে। তাঁদের দায়িত্ববোধকে সম্মান দেখাতে হবে। তাঁদের আগ্রহকে সমীহ করতে হবে। করদাতাদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচারের কাজে আগে তেমন কোনো বরাদ্দ ছিল না। কর আহরণের ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক থেকে অতীতে বর্তমানের মতো যত্নের নজির ছিল না। এখন এসব সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। 

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি