হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

দুর্নীতির করালগ্রাসে বাংলাদেশ

মিশকাতুল ইসলাম মুমু

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে। প্রায় সব আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ বারবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে স্থান পায়, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এটি একদিকে যেমন রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে।

এ অবস্থায় দেশের প্রত্যেক নাগরিকের আকাঙ্ক্ষা থাকে একটি সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক সমাজের অংশীদার হওয়া, যেখানে ন্যায়, সততা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হবে।

অতীতের অনেক সরকারই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা ব্যক্তিদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। এতে দুর্নীতিবাজরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে নিচের স্তরের কর্মচারীরাও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে দুর্নীতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণ, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার বৃদ্ধি পায়, যা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণকে পার্টি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের হাতে কেন্দ্রীভূত করে এবং জবাবদিহির অভাব সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক নিয়োগের কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হয় না। ফলে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় এবং তার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার অভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতা দুর্নীতির প্রসারকে উৎসাহিত করে। কারণ, দুর্নীতির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেকে দুষ্কৃত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। সমাজে প্রচলিত স্বজনপ্রীতি, ঘুষ গ্রহণ ও সুবিধা নেওয়ার অসৎ সংস্কৃতি দুর্নীতিকে স্বাভাবিক করার মাধ্যমে তা আরও বিস্তার লাভ করে।

অর্থনৈতিক বৈষম্য ও উচ্চ বেকারত্বের কারণে অনেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, যেখানে সরকারি চাকরি বা ব্যবসায় সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। সবশেষে, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও বিচার বিভাগের ধীরগতি দুর্নীতিবাজদের অপরাধ থেকে বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেয়, যা তাদের আরও উৎসাহিত করে। তাই এসব আন্তসংযুক্ত কারণের সমাধান ছাড়া বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয় এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান নাজুক। এই পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক ও সামাজিক কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর করা প্রয়োজন। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া কমিশনের পক্ষে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কারণ, যদি কমিশন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তবে তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। আশার কথা, অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই দুদকের সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে এবং একটি পৃথক কমিশন গঠন করেছে। যার কাজ হবে দুদকের ক্ষমতা, দক্ষতা, কর্মপ্রক্রিয়া ও কার্যকারিতা পুনর্মূল্যায়ন ও উন্নয়ন। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপ থেকে এটি মুক্ত থাকতে পারে।

অতীতে কমিশনের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ায় কার্যক্রম পরিচালনায় নানা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, ফলে এখন দুদকের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য। সেই সঙ্গে কমিশনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি, যাতে দুর্নীতির তদন্ত, প্রমাণ সংগ্রহ ও বিচার কার্যক্রম আরও দ্রুত ও কার্যকর হয়। পাশাপাশি আইনি কাঠামোকে আরও মজবুত করে তদন্ত ও বিচার যথাসময়ে করতে হবে এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতির মাধ্যমে যারা বিপুল সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দুদককে জনগণের আরও কাছে নিয়ে গিয়ে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। সব মিলিয়ে, সরকারের সদিচ্ছা এবং সংস্কারের এই উদ্যোগ যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আশা করা যায় যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে দুর্নীতি আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, জনগণের সহযোগিতা এবং কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ একত্রে কাজ করলে বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক