রাজধানীর হাজীপাড়া পেট্রলপাম্পে উপচে পড়া ভিড়। না গাড়ির নয়, মানুষের। তাদের কারও হাতে বোতল, কারও হাতে গ্যালন, আবার কেউ বেশ কসরত করে নিজের সঙ্গে আনা ড্রাম আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। বেশ একটা হট্টগোল দশা। এদের সবাই এসেছেন জেনারেটরের জন্য ডিজেল নিতে। কারণ আজ দুপুর ২টা ৫ মিনিট থেকে বিদ্যুৎ নেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অবশ্য সেই সাড়ে ৫টায় বলেছেন, সন্ধ্যা ৭-৮টার মধ্যে রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে। যদিও কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুতের দেখা মিললেও অনেক এলাকার মানুষ এখনো অধীর আগ্রহে বসে আছেন। সেসব এলাকায় এখনো ৮টা বাজেনি।
অথচ নসরুল হামিদ আজকের পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আগামী দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা যাবে। আমরা চাইলে এখনই ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারি, কিন্তু আমরা দেখতে চাইছি কোথায় সমস্যা হয়েছে। ঢাকায় বিদ্যুতের লোড বেশি থাকার কারণে আমরা একটু সময় নিচ্ছি। কারণ হঠাৎ করে লোড দিলে আবারও গ্রিড ট্রিপ করার সম্ভাবনা আছে। এর জন্যই আমরা ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে সময় নিচ্ছি।’
অথচ এখন পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকলে এমন কী ক্ষতি হয়? শুধু তো আলোর সমস্যা, সে তো অন্য কোনোভাবেও মেটানো যায়। তা যায়। মুশকিল হচ্ছে, নগর এলাকায় বিদ্যুতের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় যুক্ত থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি, তা হলো—পানি। ফলে কোনো আগাম বার্তা ছাড়াই দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার মানুষ পড়েছে পানির সংকটে।
রয়েছে আরও সংকট। শহুরে নাগরিকদের অনেকেই এখন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের কাজটি আর চেকে করেন না। তাঁদের ভরসা ইলেকট্রনিক টেলার মেশিন (এটিএম) বুথ। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় জরুরি প্রয়োজনে অনেকেই টাকা তুলতে পারছেন না। এতে সাধারণ জনজীবন তো বটেই ব্যবসায়িক লেনদেনও থমকে গেছে বলা যায়। জনভোগান্তি ছাড়েনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকেও। সেখানে ইমিগ্রেশন থমকে ছিল এক ঘণ্টা। এতে ফ্লাইট বিলম্ব হয়েছে অনেক যাত্রীর। রয়েছে নিরাপত্তার সংকট। বিদ্যুৎ না থাকায় রাস্তাঘাট আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকার। ফলে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে যখন বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক লুকোচুরি খেলতে শুরু করে, তখন ভোগান্তির মাত্রার কথা আর না বললেও চলে। কারণ, বিপদে-আপদে কাউকে ডেকে নেওয়ার নিশ্চয়তাটুকুও তখন হাত ফসকে যায়।
অথচ এই এত এত সমস্যার মূল কারণটি এখনো জানা যায়নি। যতটা যা জানা গেছে, তা হলো—বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের ডেপুটি ম্যানেজার (জনসংযোগ কর্মকর্তা) এ বি এম বদরুদ্দোজা খান আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছিলেন, ‘আজ দুপুর ২টার দিকে যমুনা নদীর পূর্ব পাশ থেকে ঢাকার দিকে আমাদের যে গ্রিড আছে তা ট্রিপ করে গেছে। গ্রিডের এই সমস্যার কারণে ঢাকার কিছু অংশ, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ অঞ্চলের গ্রাহকেরা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে।’
সংকট হতেই পারে। সংকটের সমাধানও আছে। যেকোনো সংকট সমাধানের পথে প্রথম পদক্ষেপটিই হলো এর কারণ অনুসন্ধান। এই সংকট জাতীয় পর্যায়ের হলে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব থাকে প্রতিনিয়ত জনসাধারণকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা ও আশ্বস্ত করা। পরিস্থিতি বলছে, সংকটের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও আমরা এখনো এর কারণ শনাক্ত করতে পারিনি। এ জন্য যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তার প্রতিবেদন দু-তিন দিনের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন খোদ নসরুল হামিদ। দ্রুততম সময়ে সংকটের কারণ শনাক্ত তো সক্ষমতার সঙ্গেও সম্পর্কিত। আজকের পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে, এই ক্ষেত্রে অন্তত আমরা সক্ষম হতে পারিনি। তাহলে এত উন্নয়নের গান আমরা শুনছি কী করে?
অবশ্য প্রতিমন্ত্রী মহোদয় একটি জরুরি কাজ করেছেন। তিনি নিজের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে রাজধানীর যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে অবহিত করছেন। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এই যুগে এমন সংকট দাবি করে—দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত বিরতিতে সংকট সম্পর্কে ব্রিফ করবেন। বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের পরিস্থিতিতে শীর্ষ পর্যায় থেকে বক্তব্য দিয়ে সংকট সম্পর্কে অবহিত করতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এ চর্চা নেই বললেই চলে। এমনিতে যেকোনো ইস্যুতে, ইস্যু না থাকলে ইস্যু বানিয়ে নানা পর্যায়ের নেতাদের কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু বিরাট একটা জনগোষ্ঠী যখন আক্ষরিক অর্থেই অন্ধকারে, তখন এমন কোনো বিবৃতি বা বক্তব্যের দেখা মিলছে না। অথচ এমন একটি বক্তব্য এই সময়েই ভীষণভাবে জরুরি। জনগণকে আশ্বস্ত করতেই এটি প্রয়োজন, যেখানে সংশ্লিষ্টদের চেষ্টার কথা থাকবে, থাকবে সংকটের সম্ভাব্য কারণ, সংকট সমাধানের সম্ভাব্য সময়। তাতে অন্তত গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা কমে। কে না জানে অন্ধকারে গুজব বেশি ছড়ায়।
অথচ এসব কিছুই না করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদমন্ত্রী একটি সময়কাঠামোর উল্লেখ করে সমাধান আসছে বলে পূর্বাভাস দিলেন, যা বিপুল মানুষের কাছে এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এ ধরনের সংকট সমাধানে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়ার বিপদ অনেক। সময়টি পার হলেই হাজারটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। এসব প্রশ্ন তখন ছড়াতে থাকে, ডালপালা মেলতে থাকে, নানা ধারণা ও গুজব অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটতে থাকে। কিন্তু এসব দিকে দেখা যাচ্ছে আমাদের কর্তৃপক্ষের কোনো দৃষ্টি নেই। কাঙ্ক্ষিত ৮টার খোঁজে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মতো তাঁরাও কি ঘাবড়ে গেছেন?
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা