দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এইচআইভি (এইডস) সংক্রমণ, বিশেষ করে ১৭ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, গত তিন বছরে (২০২২-২৫) দেশে নতুন করে এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৬০০ জনের বেশি এবং মারা গেছে অন্তত ৬০০ জন। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই শনাক্ত হয়েছে ৮৮২ জন।
যশোর ও রাজশাহীর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ১৭ থেকে ২৩ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি।
২০২২ সালে দেশে নতুন করে এইচআইভিতে আক্রান্ত হয় প্রায় ৯৪৭ জন। মৃত্যুবরণ করে ২৩২ জন। পরের বছর শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৭৬ জন এবং মৃত্যু হয় ২৬৬ জনের।
২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন করে সংক্রমিত হয়েছে ১ হাজার ৪৩৮ জন। একই সময়ে মারা গেছে ১৯৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় সংক্রমণের হার বেড়েছে; বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যশোরে নতুন করে ৪০ জনের দেহে এইচআইভি ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৫ জনই শিক্ষার্থী। আক্রান্তদের বয়স ১৭ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। গত বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তথ্য বলছে, আক্রান্তদের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ ও ১৪ জন নারী। বর্তমানে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার ২২০ জন এইচআইভি রোগী এ হাসপাতালের অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছে।
ডা. কানিজ ফাতেমা বলেন, তরুণদের মধ্যে সংক্রমণের হার বর্তমানে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কৌতূহল এবং যৌনশিক্ষার অভাবে অনেকে অনিরাপদ সম্পর্কে জড়াচ্ছে। সচেতনতা ছাড়া এই প্রবণতা ঠেকানো সম্ভব নয়।
সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় যশোরে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। জেলার প্রায় ৩০ লাখ জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনের বেশি এইডস রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সেলিং (এইচটিসি) সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত নতুন করে ২৮ জনের দেহে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছে এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে বর্তমানে ১৪ থেকে ১৭ হাজার মানুষ এইচআইভি নিয়ে বেঁচে আছে। যদিও সামগ্রিক প্রাদুর্ভাব (১৫–৪৯ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে) ০.১ শতাংশের কম। তবু কিছু ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীতে সংক্রমণ হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
তরুণদের মধ্যে এইচআইভি বাড়ার পেছনে কয়েকটি স্পষ্ট কারণ রয়েছে—যৌন সচেতনতা ও শিক্ষা ঘাটতি, কনডম ব্যবহার কম, অরক্ষিত যৌন সম্পর্ক, ড্রাগ বা ইনজেকশন ব্যবহার, সামাজিক ট্যাবু ও স্টিগমা।
সিরাজগঞ্জ জেলায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এইচআইভি পজিটিভ এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এইচআইভি সেন্টারের তথ্যমতে, জেলায় ২৫৫ জন পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার ৭৩ শতাংশই ইনজেকটিভ ড্রাগ ব্যবহারকারী। এতে শঙ্কায় রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে একই সিরিঞ্জে মাদক গ্রহণ, রোগের তথ্য গোপন, তরুণদের সচেতনতার অভাব এবং অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ককে দায়ী করছেন চিকিৎসকেরা।
প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে আসা নেশাজাতীয় ইনজেকশনের মাধ্যমে এই রোগ বেশি ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আক্রান্তদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা এবং ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইনজেকটিভ ড্রাগের ব্যবহার কমাতে নিয়মিত অভিযান চলছে।
এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর মাসুদ রানা বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলায় আক্রান্ত ২৫৫ জনের মধ্যে ইনজেকটিভ ড্রাগ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৮৭ জন। আর কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৯ জন। এ ছাড়া সাধারণ ৩৫ জন ও যৌনকর্মীর সংখ্যা চারজন। যে কারণে সিরাজগঞ্জ জেলাকে এরই মধ্যে রেড জোন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এক সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যুবকদের মধ্যে এইডস-বিষয়ক সচেতনতা এখনো সীমিত। প্রায় ৬০ শতাংশ টেলিভিশন থেকে এ সম্পর্কে শুনেছেন, কিন্তু মাত্র ৪৫ শতাংশ জানেন, যৌন মিলন সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম।
দেশে বর্তমানে জাতীয় এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচির অধীনে বিনা মূল্যে এইচআইভি স্ক্রিনিং, কাউন্সেলিং এবং এআরটি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
সময়মতো পরীক্ষা এবং চিকিৎসা শুরু করলে এইচআইভিতে আক্রান্তরাও দীর্ঘদিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। তবে সামাজিক লজ্জা, বৈষম্য ও তথ্যের অভাব এখনো বড় বাধা হয়ে আছে।
সূত্র: এনএএসপি বার্ষিক রিপোর্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে জাতীয় এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচি, ইউএসএফপিএ ও ডব্লিউএইচও যৌথ প্রকাশনা, ইউএস এআইডিএস— কান্ট্রি ফ্যাক্টস বাংলাদেশ