হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী ও অসাম্প্রদায়িক নজরুল

অরুণাভ পোদ্দার

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৫তম মৃত্যুতিথিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্নও মাথায় ঘুরছে। তা হলো, আমরা জাতীয় কবির আদর্শ ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি?

দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, প্রেমের কবি—সব বিশেষণেই আমরা তাঁকে বিশেষায়িত করতে পারি। কিন্তু সবার আগে কাজী নজরুল ইসলামের মূল্যায়ন হওয়া উচিত মানুষের কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি হিসেবে।

‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, 
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’ 

নজরুল ইসলাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, 
‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, 
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই’ 

যিনি এই কথাগুলো লিখতে পারেন, সেই এক শতাব্দী আগে, তিনি অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিভূ, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। 
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা নজরুলকে ধারণ করছি খণ্ডিত নজরুল হিসেবে। এটা সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চলে আসছিল। পাকিস্তানি শাসক ও তাদের অনুগত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী শুরু থেকেই কবিকে শুধু একটি ধর্মের মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পাকিস্তান আমলে এদেশীয় কিছু বুদ্ধিজীবী সাম্প্রদায়িকতা ছড়াতে কাজী নজরুলের সাহিত্যে অর্বাচীনের মতো কাঁচি চালিয়েছিলেন। তারই একটি উদাহরণ—

নব নবীনের গাহিয়া গান
সজীব করিব মহাশ্মশান, 
আমরা দানিব নতুন প্রাণ
বাহুতে নবীন বল! 

‘মহাশ্মশানে’ তাদের গাত্রদাহ  হয়েছিল। তাই তা পরিবর্তন করে গোরস্থান করেছিল। পাকিস্তান রেডিও, টেলিভিশনে নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রায় নিষিদ্ধই ছিল। নিষিদ্ধ ছিল নজরুলের বিখ্যাত শ্যামাসংগীত, হিন্দু পুরাণ নিয়ে লেখাগুলো অঘোষিতভাবে। এর ফলে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবিকে আমরা হারিয়ে ফেলি। এতে যত না ক্ষতি হয়েছে কবির, তার থেকে শতগুণ ক্ষতি হয়েছে বাঙালির ও তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় কবিকে ফিরিয়ে আনা হলো ঢাকায়। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হলো। কবি তখন অসুস্থ, বহু আগে থেকেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁকে ধানমন্ডিতে বাড়ি, রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা এবং পরিবারের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়।

’৭৫-এর রক্তাক্ত পটপরিবর্তনের পর তৎকালীন সামরিক শাসকেরা পাকিস্তান আমলের মতো নজরুলকে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। মনে আছে, তখন থেকেই রেডিও-টেলিভিশনে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নির্বাসিত। একজন খ্যাতিমান নজরুলসংগীতশিল্পী বলেছিলেন, আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একবার নজরুলসংগীত গাইতে গেছেন। বেশ কয়েকটি গানের মধ্যে একটি ছিল শ্যামাসংগীত, আরেকটি ছিল ‘যবে তুলসী তলায় প্রিয় সন্ধ্যা বেলায়’। তো পরিচালক বললেন, এ দুটো গান প্রচার করা যাবে না। সেই শিল্পী আত্মসম্মান রক্ষা করে বিনয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান বর্জন করলেন। ঠিক তেমনি ওপার বাংলায় কবির ইসলামি সংগীত প্রায় গাওয়াই হয় না।

কবি নিজেই বলেছেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান’, যা আমাদের পরম গর্বের বিষয় হতে পারত। নজরুল একাধারে ইসলামি গান যেমন লিখেছেন, তেমনি দুহাত ভরে শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। বাংলায় হামদ, নাত লিখে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত ইসলামি গান—
তৌহিদেরি মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম। 
ঐ নাম জপলেই বুঝতে পারি খোদায়ী কালাম–
মুর্শিদ মোহাম্মদের নাম।

অন্যদিকে হিন্দু পুরাণ ও শাস্ত্র নিয়ে তাঁর পড়াশোনা ছিল ঈর্ষণীয়। তাই তো তিনি অবলীলায় লিখতে পারেন—         

মহাকালের কোলে এসে গৌরী হ’ল মহাকালী, 
শ্মশান–চিতার ভস্ম মেঘে ম্লান হ’ল মার রূপের ডালি.... 
...উমা হ’ল ভৈরবী হায় বরণ ক’রে ভৈরবেরে, 
হেরি’ শিবের শিরে জাহ্নবী রে শ্মশানে মশানে ফেরে। 

ভেবে বিস্মিত হতে হয়, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করা একজন, তা-ও আবার গ্রামের মসজিদে ইমামতি করে ও লেটোর দলে যাত্রাপালার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে যিনি জীবন চালাতেন, তিনি কীভাবে অন্য ধর্ম সম্পর্কে এত বিস্তারিত জানলেন!

এই যে নব্বইয়ের দশকে সমাজতন্ত্রের পতনের পর সারা বিশ্বে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যা এই উপমহাদেশের রাজনীতিকে করে তুলছে কলুষিত, তা থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রসার। এখানে বলে রাখি, আমাদের দেশে একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মাঝে দেখা যায় নজরুল ইসলামের সাম্যবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে আড়াল করে রবীন্দ্রনাথের বিরোধী হিসেবে দাঁড় করানোর প্রবণতা। আর আমাদের একশ্রেণির স্বল্পশিক্ষিত সমাজে তা গ্রহণযোগ্যতাও পাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতিজগতের আলোকবর্তিকা প্রয়াত ওয়াহিদুল হক তাঁর বিখ্যাত কলাম ‘এখনো গেল না আঁধার’-এ আজ থেকে দুই যুগ আগেই বলেছিলেন এ দেশের একশ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিতজনদের কথা। যারা বিশ্বাস করত রবীন্দ্রনাথ নাকি কাজী নজরুলকে হিংসা করতেন। নজরুল যাতে নোবেল না পান, তাই নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে ধ্বংস করার জন্য তিনি (রবীন্দ্রনাথ) নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।

শুধু তা-ই নয়, বিষ খাইয়ে নজরুলকে বাকরুদ্ধ করার হাস্যকর অভিযোগও তাঁর বিরুদ্ধে করতে পিছপা হয়নি! এ ধরনের হাস্যকর ও বালখিল্য অভিযোগের উত্তর দেওয়ার রুচিও নেই বিদগ্ধ সমাজের। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের সমাজের তথাকথিত শিক্ষিতরাও বছর কয়েক আগে চাঁদে কাকে দেখা গেছে, তাই বিশ্বাস করে দেশজুড়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছিল। সত্য হলো, রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক ছিল দারুণ। নজরুল ইসলাম কবিগুরুকে গুরুদেব হিসেবে সম্বোধন করতেন।

আবার কবিগুরুও নজরুলকে শুধু স্নেহই করতেন না, তাঁর লেখার প্রশংসা করে উৎসাহ দিতেন; বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলামের আরবি, ফারসি শব্দের ব্যবহারকে।

নজরুলকে তিনি নূতন যুগের, নূতন চেতনার কবি হিসেবে দেখতেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটিকা কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। যদিও একশ্রেণির কবিগুরুভক্ত এতে নাখোশ হয়েছিলেন। আবার নজরুল যখন হুগলি জেলে অনশন করেছিলেন, কবিগুরুই তখন তাঁকে টেলিগ্রাম করে তা ভাঙতে অনুরোধ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর ব্যথিত নজরুল লিখলেন ‘রবিহারা’ কবিতাটি, ‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত-পথের কোলে’। গানে লিখলেন, ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’। রবীন্দ্রনাথের শবযাত্রার ধারাবিবরণী নজরুল স্বকণ্ঠে দিয়েছিলেন আকাশবাণী কলকাতা থেকে। তাই এ থেকে প্রতীয়মান হয়, রবীন্দ্র-নজরুল সম্পর্ক আসলে কেমন ছিল।

একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ রবীন্দ্র-নজরুলের সম্পর্ককে বিষিয়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের দুই মহান পুরুষকেই শুধু ছোট করছেন না, বাংলার চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকেও রুদ্ধ করতে চাইছেন।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে এই উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনা যখন প্রশ্নের সম্মুখীন, তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল কাজী নজরুল ইসলামের মতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার মনীষীদের। তিনি স্বধর্মের মধ্যে থেকেও জীবনে ও পরিবারে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করে গেছেন। 
নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, বিদ্রোহ করেছিলেন ধর্মের নামে শোষণের বিরুদ্ধে, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে।

একালে যেমন, সেকালেও তেমনি ধর্মকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ভণ্ড মোল্লা-মৌলভি আর পুরোহিত-পাদরির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাইতো ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি লিখলেন সেই অমর বাণী, 
আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, 
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী, 
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী! 

যখন ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’ তখনি আরও বেশি করে দরকার নজরুলকে, যিনি অবলীলায় বলতে পারেন, 
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানেনা সন্তরণ, 
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ! 
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? 
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র! 

বাঙালি যেদিন হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ ও চেতনায় নজরুলকে স্থান দিতে পারবে, তখন জাতীয় জীবনে যতই বিঘ্ন-বিপদ আসুক, যতই হাওয়া প্রতিকূল হোক না কেন, বাংলাদেশ ও বাঙালির জয় সুনিশ্চিত। কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনা শুধু বাংলাদেশের জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, প্রয়োজন সমগ্র উপমহাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের জন্যই। বিশ্বকে বাসোপযোগী করে তুলতে আমাদের নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনার কাছে ফিরে যেতেই হবে। 

লেখক: চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি