হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে বিপদ বাড়ছে

অরুণ কর্মকার

আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীকে জলবায়ু-বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ১২ নভেম্বর আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ২৯-এর ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমাদের একটি ভিন্ন জীবনধারার ওপর ভিত্তি করে আরেকটি পাল্টা সংস্কৃতি গড়তে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্যপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে, কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।’

মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যে বিশ্ব পরিসরে আরও একবার তাঁর একটি লালিত স্বপ্নের কথা প্রকাশিত হয়েছে। স্বপ্নটি হলো—একটি নতুন পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে তাঁর ‘তিন শূন্য’-ভিত্তিক দর্শন বাস্তবে রূপায়ণের। কিন্তু মানবজাতির (প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর তাবৎ প্রাণিকুলের) দুর্ভাগ্য হলো, পৃথিবীতে অব্যাহতভাবে যা ঘটে চলেছে তার প্রায় সবই তাঁর এই স্বপ্নের বিপরীত। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের মতো একটি বৈশ্বিক ফোরামে যখন তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা, মানবজাতির নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরে বক্তব্য দিলেন, ঠিক তখন বিজ্ঞানীদের একটি আশঙ্কার কথাও প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে চলতি বছর পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা অতীতের যেকোনো বছরের রেকর্ড অতিক্রম করবে।

যুক্তরাজ্যের দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ কপ২৯-এর একটি রিপোর্টকে উপজীব্য করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কপ২৯-এর রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবী এখন ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপর্যয়কর পথে অগ্রসর হচ্ছে। অথচ মাত্র এক বছর আগে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে (কপ২৮) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সামান্যতম লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং এবারের জলবায়ু সম্মেলনে প্রকাশিত তথ্য হলো, কয়লা, তেল কিংবা গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে এই গ্রহকে উত্তপ্তকারী কার্বনের নিঃসরণ গত বছরের চেয়ে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। পৃথিবীর এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শূন্য কার্বনভিত্তিক জীবনব্যবস্থার কথা বলেছেন, যা অর্জন করার মতো বড় চ্যালেঞ্জ দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। তবে মানবজাতিকে বাঁচাতে হলে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

কপ২৮-এ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ফিরে আসার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন বিশ্বনেতারা। সে সময় এ সিদ্ধান্তকে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। কারণ, এর আগের ২৭টি সম্মেলনে কখনোই এমন প্রস্তাব আসেনি। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারকেই মূল কারণ বলে বিবেচনা করা হয়। তাই ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই প্রসঙ্গে গত সোমবার কপ২৮-এর সভাপতি সুলতান আল জাবের কপ২৯-এ দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘ইতিহাস আমাদের কাজ দেখে বিচার করবে, কথায় নয়।’ তাঁর কথার অর্থ হলো, বিশ্বনেতারা শুধু কথাই বলে যাচ্ছেন। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ইতিহাসে তাঁদের স্থান সেভাবেই নির্ধারিত হবে।

এই যে শুধু কথা হয়, কিন্তু কাজ হয় না। কখনো কখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও হয়, কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। ভালো ভালো কথা যেগুলো বলা হয় সবাই তার প্রশংসাও করেন। কিন্তু তার বাস্তবায়নে যেভাবে কাজ করা দরকার তা করেন না। এর কারণ কী? আমি নিশ্চিত, আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-ভিত্তিক যে নতুন জীবনধারা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, তা দারুণভাবে প্রশংসিত হবে। বিশ্বনেতারা তাঁর বক্তব্যের প্রতি সমর্থনও জানাবেন। কিন্তু ওই ধারণা বাস্তবায়নে করণীয়গুলো করবেন না। ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত প্রথম কপ থেকেই এই ধারা চলে এসেছে। এই ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়েন পৃথিবী নিয়ন্ত্রণকারী রাজনীতিক ও বিশ্বনেতারা।

এবার একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, হাতে গোনা যে কয়েকটি দেশ সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে আসছে তার একটিও কপ২৯-এর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেয়নি। যোগ দেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান কী হবে, তা-ও অনিশ্চিত। এই প্রসঙ্গে পরিবেশবিজ্ঞানী বিল হেয়ার বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, পরিবেশ নিয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাগিদটাই নেই। ঠিক এই কারণেই কথা হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না।

এ কথা ঠিক যে গত এক বছরে বিশ্ব মারাত্মক সব তাপপ্রবাহ, দাবানল, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দেখেছে। ফলে কপ২৯-এ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার দ্রুত কমানোর ক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদের ও নীতিনির্ধারকদের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রধান প্রধান বিশ্বশক্তি কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কার্যত অনাগ্রহী। কারণ, কার্বন নিঃসরণই তাদের মোড়লিপনা অর্থনীতির প্রাণশক্তি। সেখানে তারা ছাড় দিতে নারাজ। তাই তারা একটা ভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন করেছে। সেটা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত কমাতে উন্নয়নশীল দেশের জন্য অর্থ সহায়তা। যদিও সেটা তারা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী করছে না। তারপরও এবারের কপ২৯-এরও অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় সেই সহায়তার বন্দোবস্ত করা। যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে জর্জরিত দেশগুলো তাদের দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন করতে পারে।

বলা বাহুল্য, এই কৌশল শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা প্রাণিকুল রক্ষায় বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলো যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে, তা বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় নস্যিমাত্র। উন্নয়নশীল দেশগুলো ওই বৃহৎ শক্তিগুলোর কৃতকর্মের কুফলভোগী, সে হিসাবে তাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে ঠিকই। পাশাপাশি বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো যদি কার্বন নিঃসরণের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ না কমায়, তাহলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। কিন্তু আবারও বলতে হচ্ছে, মানবজাতির দুর্ভাগ্য যে বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর সেসব দেশের রাজনীতিক ও রাষ্ট্রনায়কদের এই ক্ষেত্রে অনীহা অপরিমেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাঁদেরও ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো সক্ষমতা তাঁদের আছে। আমাদের মতো দেশগুলোর তা একেবারেই নেই।

মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিবছর আয়োজিত ‘কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ)’ শিরোনামের এই জলবায়ু সম্মেলনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন। জানা গেছে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে তিনি বলেছেন, প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ডেকে এনে দেনদরবার করানোটা অপমানজনক। এ ধরনের সম্মেলন প্রতিবছর আয়োজন করার কোনো দরকার নেই। এর আগেও কেউ বলেছেন যে কপগুলো জাতিসংঘ আয়োজিত বার্ষিক পিকনিকের মতো হয়ে উঠেছে। এসব সম্মেলনের কোনো কার্যকারিতা নেই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি