হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

জনবিক্ষোভে নতুন নেপাল

হুসাইন আহমদ

মাত্র কয়েক দিন আগে নেপালে বিক্ষোভের কারণে সরকারের পতন ঘটেছে। ছবি: সংগৃহীত

হঠাৎ জ্বলে ওঠা নেপালের জেনারেশন জেড বিদ্রোহ যেমন দ্রুতই থেমে গেছে, তেমনি এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। বরং এর অভিঘাত ভবিষ্যতের রাজনীতিকে স্পষ্টভাবে প্রভাবিত করবে। নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে, প্রতিটি আন্দোলনই রাষ্ট্রকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। ১৯৯০ আর ২০০৬ সালের জন-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। কিন্তু গণতন্ত্রও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়। কিছু উন্নয়ন হলেও তরুণ প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট—বেকারত্ব থেমে থাকল আগের জায়গাতেই।

এই প্রজন্মের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে আরেকটি বিষয়। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা ও ধনী পরিবারের সন্তানেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন বিলাসী জীবনের ঝলমলে ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন তা দারিদ্র্যে জর্জরিত তরুণদের কাছে যেন একধরনের উপহাস হয়ে দাঁড়ায়। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত ছিল শেষ স্পার্ক, যা দেশজুড়ে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়।

এর আগে শ্রীলঙ্কা (মার্চ ২০২২), বাংলাদেশ (জুলাই ২০২৪) আর ইন্দোনেশিয়া (জুলাই ২০২৫)—এই তিন দেশেই একই রকম তরুণ বিদ্রোহ ঘটেছে। নেপালের তরুণদের বড় অংশ বলেছে, তারা ইন্দোনেশিয়ার আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। দুই দেশেই ওয়ান পিস-এর জল্লি রজার পতাকা বিদ্রোহীদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

এই আন্দোলনগুলোর কোথাও কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। প্রথাগত রাজনৈতিক দলও ছিল অনুপস্থিত। শিক্ষার্থীরাই ছিল মূল চালিকাশক্তি। রাতারাতি বিস্ফোরিত হওয়া এসব আন্দোলনের পূর্বাভাস কোনো সরকারই বুঝতে পারেনি।

১৯৬৮ সালের বৈশ্বিক বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গ্রিক আমেরিকান ইতিহাসবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক জর্জ কাৎসাফিকাস ‘এরস এফেক্ট’ ধারণা ব্যবহার করেছিলেন। একসঙ্গে বহু বিদ্রোহ, অভিন্ন প্রতীক আর নতুন মূল্যবোধে বিশ্বাস—এটাই এর বৈশিষ্ট্য। আজকের পরিস্থিতি অনেকটাই তার পুনরাবৃত্তি। তখন যেমন একই সঙ্গে নানা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, আজও তেমনি দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রতীকের প্রতি অভিন্ন আকর্ষণ, পুরোনো বিভাজন অতিক্রম করে অভিন্ন মূল্যবোধে বিশ্বাস—সব মিলিয়ে এই বিদ্রোহগুলোকে একই সূত্রে গেঁথে রাখছে।

এশিয়ার ধারাবাহিক বিদ্রোহের ইতিহাসও এখানে গুরুত্বপূর্ণ—ফিলিপাইন (১৯৮৬), দক্ষিণ কোরিয়া (১৯৮৭), মিয়ানমার (১৯৮৮), তিব্বত-তাইওয়ান-চীন (১৯৮৯), নেপাল ও বাংলাদেশ (১৯৯০), থাইল্যান্ড (১৯৯২), যা বর্তমান তরুণ বিদ্রোহের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে।

আজকের প্রেক্ষাপটে দেখলে, এসব আন্দোলন ঢাকায় ও কাঠমান্ডুতে সরকার পতন ঘটিয়েছে, কলম্বো ও জাকার্তায় এনেছে একসময়ের অকল্পনীয় সংস্কার। বাংলাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হন নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। একই বছর শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনে জয়ী হন বামপন্থী প্রগতিশীল নেতা অনুড়া কুমারা দিশানায়েকে। নেপালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০২৬ সালের ৫ মার্চ দেশটিতে নির্বাচন হবে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘প্রত্যেক দুর্নীতিবাজ রাজনীতিককে’ শাস্তি দেবেন। তবে তা তিনি রাখতে পারবেন কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।

এদিকে ফ্রান্সেও শুরু হয়েছে নতুন আন্দোলন—‘ব্লক এভরিথিং’। প্রেসিডেন্ট মাখোঁর কৃচ্ছ্রনীতির বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ ১০ সেপ্টেম্বর রাস্তায় বিস্ফোরিত হয়। ৫৫০ জায়গায় অন্তত ১ লাখ ৭৫ হাজার মানুষ সড়ক অবরোধে নামে। সকালবেলার যান চলাচল সচল রাখতে ৮০ হাজার পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল, ফ্ল্যাশ গ্রেনেড আর লাঠিপেটা করে। গ্রেপ্তার হয় অন্তত ৫০০ জন। হাসপাতালের কর্মী থেকে রেলশ্রমিক—বিভিন্ন পেশার মানুষ যোগ দেয় এ আন্দোলনে।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া ও নেপালের মতো ফ্রান্সের এই আন্দোলনও নেতৃত্বহীন, তৃণমূল থেকে উঠে আসা। আর এ কারণেই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের মনে আতঙ্ক জাগছে—তাঁদের পালাও কি সামনে?

বিশ্বের এক প্রান্তের আন্দোলন অন্য প্রান্তে যে প্রতিক্রিয়া ডেকে আনে, এ ইতিহাস নতুন নয়। একবার যখন বিদ্রোহ সাধারণ হয়ে ওঠে, তখন সেটিকে দমন করা কঠিন হয়ে পড়ে। হয় তা পূর্ণ বিজয়ে শেষ হয়, না হয় রাষ্ট্র ভয়াবহ দমননীতি চালায়। কাঠমান্ডু ও জাকার্তার শান্ত প্রত্যাবর্তন ইঙ্গিত দিচ্ছে, সরকার ও আন্দোলনকারীরা হয়তো সহমর্মিতা ও উদারতার মাধ্যমে নতুন ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে প্রস্তুত।

লেখক: সাংবাদিক

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি