জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে বলে রাজনৈতিক দলগুলোকে হুঁশিয়ার করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেছেন, ওসমান হাদির ওপর হামলা পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ; এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি হতে না দেওয়া। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে।’
গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এই সতর্কবার্তা দেন প্রধান উপদেষ্টা।
ইনকিলাব মঞ্চের নেতা ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর আক্রমণটি ‘খুবই সিম্বলিক’ আখ্যায়িত করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়।
রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধিতা যতই থাকুক না কেন, জাতির স্বার্থে এবং জুলাইয়ের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনের সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তবে মাথায় রাখতে হবে—এটি যেন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন দলের বৈঠকের পর তাঁর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। শাহবাগ অথবা শহীদ মিনারে যে প্রতিবাদ সভা হবে, সেখানে যেন সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই পরদিন শুক্রবার রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করা হয় জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় নেতা ওসমান হাদিকে। মাথায় গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদি এখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। তাঁর অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন।
জুলাই আন্দোলনের সময় এক থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তির মধ্যে দূরত্ব দেখা দিয়েছে এরই মধ্যে। এই অবস্থার মধ্যে হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল যমুনায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে হাদির ওপর হামলাকে ‘ষড়যন্ত্রের’অংশ হিসেবে তুলে ধরেন তিন দলের নেতারা। সেখানে হারিয়ে যাওয়া ঐক্য পুনরুদ্ধারের তাগিদও দেন তাঁরা।
বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেকোনো অবস্থাতেই পরস্পরের দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নানা বক্তব্য একে অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়িয়েছে, যার ফলে আমাদের বিরোধীরা সুযোগ পেয়েছে। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছি। জাতিকে বিভক্ত করে, এমন কথা আমরা কেন বলব?’
হাদির ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বলেন, জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মনে হয় যারা অভ্যুত্থান করেছে, তারা অপরাধ করেছে। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে নরমালাইজ করতে নানা চেষ্টা চলছে। টিভি টক শোতে তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মিলিত হচ্ছে এবং আদালত প্রাঙ্গণে স্লোগান দিচ্ছে।
অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে সুযোগ করে দিচ্ছে মন্তব্য করে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বার্থে দলগুলো আওয়ামী লীগকে নানা রকম সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।’
বৈঠকে উপস্থিত থাকা আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল দলগুলোকে সতর্ক করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা যতই থাকুক না কেন, জাতির স্বার্থে এবং জুলাইয়ের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য দলগুলোর আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।
প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এ ক্ষেত্রে সুদৃঢ় অবস্থান নেবে তারা। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে, সে জন্য পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর কথাও বলেন বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা।
যমুনায় ওসমান হাদির পরিবার
ওসমান হাদির পরিবার গতকাল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ওসমান হাদির ভাই আবু বকর সিদ্দীক, বোন মাসুমা এবং ইনকিলাব মঞ্চের তিন নেতা আবদুল্লাহ আল জাবের, ফাতিমা তাসনিম জুমা ও মো. বোরহান উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রধান উপদেষ্টা এ সময় ওসমান হাদির সর্বোত্তম চিকিৎসা নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন তাঁদের।
ওসমান হাদির বোন বলেন, ‘সে ছোটবেলা থেকেই দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। ছোটবেলা থেকেই সে বিপ্লবী। বিদ্রোহী কবিতা তার প্রিয়, সে বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করতে ভালোবাসত। তার একটি ১০ মাসের সন্তান আছে। হাদি আমাদের মেরুদণ্ড।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওর অনেক কাজ, ওকে বেঁচে থাকতে হবে। আপনারা বিপ্লবী সরকার। যে করেই হোক জুলাই বিপ্লবীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তা না হলে এ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়বে।’
অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের নেতা জাবের বলেন, ‘৫ই আগস্টের পর অনেকে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু ওসমান হাদি বাসায় ফিরে যায়নি। সে জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করত এবং জুলাই বিপ্লবের জন্য দিনরাত কাজ করছে। যে ছেলেটা গুলি করেছে, শুনতে পাচ্ছি সে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিল। কোন প্রক্রিয়ায় সে জামিন পেয়েছে সেটা তদন্ত করতে হবে।’
এ সময় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।