ডাবলিন থেকে ভিয়েতনাম। এই দীর্ঘ পথে ইউরোপ, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার মরুভূমি পার হয়ে তাঁরা যখন ভিয়েতনামে পৌঁছালেন, সেখানকার প্রাণবন্ত আতিথেয়তা, কম খরচের গেস্টহাউস এবং মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা তাঁদের নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জোগাল। ডাবলিন থেকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে হ্যানয় পৌঁছাতে তাঁদের লেগেছে আট মাস। এই অসাধ্য সাধন করেছেন এক আইরিশ দম্পতি—মার্ক ও এলি।
ট্রামোরের বাসিন্দা মার্ক ও এলি গত ১ ফেব্রুয়ারি এই রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু করেন। তাঁদের এই অ্যাডভেঞ্চারের অনুপ্রেরণা ছিলেন ডারভলা মারফি। ১৯৬৫ সালে আয়ারল্যান্ড থেকে সাইকেল চালিয়ে ভারতে পৌঁছেছিলেন মারফি। মার্কের কথায়, ‘পৃথিবীকে গভীরভাবে অনুভব করা এবং জীবনকে পূর্ণভাবে যাপন করার জন্য সাইকেল ভ্রমণই হলো সেরা উপায়।’ একটার পর একটা দেশ ভ্রমণ করে তালিকা দীর্ঘ করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়; বরং বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে কাছ থেকে দেখা।
এই বিশাল ভ্রমণের জন্য সঞ্চয় করতে তাঁদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তাঁরা ম্যাপি নেভিগেশন অ্যাপ ব্যবহার করে নিজেদের গতিপথ ঠিক রাখেন। ভিয়েতনামের ঝড়ের মধ্যে দিনে ৩২ কিলোমিটার থেকে কাজাখস্তানের সমতল রাস্তায় ১৬৫ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে চলতে হয়েছে তাঁদের। মার্ক জানান, ভিয়েতনামে খরচ অনেক কম। একটি ভালো গেস্টহাউসে রাত কাটানোর জন্য তাঁদের খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১১ ইউএস ডলার। তিনি ইউরোপের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করে বলেন, ‘ইউরোপে এর চেয়ে অনেক নিম্নমানের গেস্টহাউসের জন্য আমাদের ১০ গুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হতো।’
তবে ভিয়েতনামের উষ্ণ আতিথেয়তা তাঁরা পেয়েছিলেন কাই চিয়েন দ্বীপের একটি হোমস্টেতে। সেখানে সকাল ৯টায় ঘুম থেকে উঠে এই দম্পতি দেখতে পান, জমজমাট কারাকাওকে পার্টি চলছে। বয়স্ক পুরুষেরা মন ভরে গান গাইছেন, কেউ সুরে, কেউ বেসুরে—কিন্তু সবার মধ্যেই ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি। মার্ক ও এলিকেও ‘লিটল বক্সেস’ গানটি গাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে মুগ্ধ ছিলেন মার্ক ও এলি। কারাকাওকে পার্টির আমেজ ফেলে তাঁরা উপকূলের দিকে যাত্রা করেন শীতল সামুদ্রিক বাতাস আর গ্রামীণ মানুষের আন্তরিকতার সঙ্গে মিশে যেতে।
মন ছুঁয়ে যাওয়া মানুষের ভালোবাসা
‘সাইক্লিং আমাদের ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন দেখতে অনেক সাহায্য করেছে।’ অভিজ্ঞতার ঝুলি হাতড়িয়ে বলেন মার্ক। তাঁরা সেখানকার বাগান, ধানখেত, কৃষিকাজ এবং পারিবারিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য দেখে বিস্মিত হন। ছোট শহরগুলোতে শিশুরা হাত নেড়ে তাঁদের অভ্যর্থনা জানায়। মার্ক বলেন, ‘এ ধরনের মুহূর্তগুলো কঠিন দিনগুলোকেও সহজ করে তোলে। ভিয়েতনামের মানুষের দয়া প্রতিদিন আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে।’
মার্ক ও এলির অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে দিয়েছেন ভিয়েতনামের মায়েরা। তাঁরা যাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন, সেই আকারে ছোটখাটো আর বড় মনের নারীরা এই অচেনা অতিথিদের প্রতি যেভাবে খেয়াল রেখেছিলেন, তা মার্ক ও এলির হৃদয় ছুঁয়ে গেছে গভীরভাবে। কেউ মার্ককে রোদ থেকে বাঁচতে শর্টস না পরার জন্য বকা দিয়েছেন, কেউ বৃষ্টিতে রেইন পঞ্চ দিয়েছেন, আবার এক ফো দোকানের মালিক তাঁকে শীতল জায়গায় বসিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। অচেনা মানুষের প্রতি ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষের বন্ধুর মতো আচরণ তাঁদের মুগ্ধ করে। মার্কের বিশ্বাস, এই উষ্ণ আতিথেয়তা ভিয়েতনামের সংস্কৃতির মূল অংশ, যা আসে মানুষের প্রতি মানুষের সত্যিকারের উদ্বেগ থেকে।
খাদ্য ও বিশ্রাম
ভিয়েতনামে প্রায় এক মাস থাকার পর দেশটি সম্পর্কে ধারণা বদলে যায় এই দম্পতির। মার্ক তাঁর ব্লগগুলোতে বিরক্তিকর দেশ হিসেবে ভিয়েতনামকে নিয়ে যেসব মন্তব্য পড়েছিলেন, তা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় মার্ক খুশি হয়েছেন। টাইফুন বুয়ালোইয়ের মতো একটি ঝড় ছাড়া দেশটিতে তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই ভালো। তবে তাঁদের সত্যিকারের সমস্যা ছিল এখানকার খাবার। খাবারগুলো এতই সুস্বাদু ছিল যে তাঁরা মাঝে মাঝে বেশি খেয়ে ফেলতেন বলে সাইকেল চালানোই কঠিন হতো।
তিন মাসের ভিসা নিয়ে ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন মার্ক ও এলি। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি কাটানোর জন্য দেশটি তাঁদের কাছে আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছিল। বুড়ো আঙুল তুলে উৎসাহ দেওয়া, কৃষকের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানানো—এসবই তাঁদের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। মার্ক বলেন, ‘এখানকার আশাবাদ ও আতিথেয়তা সত্যিই মনকে সুস্থ করে তোলে।’ তিনি ভিয়েতনামকে এর সুন্দর দৃশ্য, খাবার এবং কম খরচের কারণে সাইক্লিস্টের স্বর্গ বলে অভিহিত করেন।
সূত্র: ইভিএন এক্সপ্রেস