‘স্টার্ট ইয়োর মর্নিং স্লো, জাস্ট স্লো’। বাস্তব দৃশ্য হচ্ছে এর ঠিক উল্টো। সকালে ঝট করে বিছানা ছেড়ে একটার পর একটা কাজ করতে থাকি আমরা। কোনোরকমে মুখে খাবার গুঁজে তৈরি হয়ে কাজের উদ্দেশে বের হওয়া। তারপর সারা দিন একেকজন একেক বিষয়ে ব্যস্ত থাকি। পরদিন আবারও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
এই একই চক্রের আবর্তে ঘুরতে থাকা জীবনে সকালের স্নিগ্ধতা অনুভব করার সময় কোথায়! রাতের ঘুমের পর আপনি নিজেও যে এক নতুন মানুষ হয়ে জেগে উঠেছেন, সেটা উপলব্ধি করার আগেই দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে রোজ। এসব তাড়াহুড়োকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সকালের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করে স্লো মর্নিং। অর্থাৎ নিজের জীবনে দিনের শুরুটাকে পাকাপোক্ত জায়গা করে দেওয়ার কাজই করে স্লো মর্নিং রুটিন। বর্তমানে নেটিজেন ও ভ্লগাররা এই স্লো মর্নিং রুটিনে বুঁদ হয়ে আছেন। আর তাই এ লেখার অবতারণা।
স্লো মর্নিং রুটিন আসলে কী
স্লো মর্নিং বা ধীরেসুস্থে সকাল শুরু করার মানে হলো তাড়াহুড়ো বা চাপ ছাড়া একটি স্বাচ্ছন্দ্যময় গতিতে দিন শুরু করা। ঘুম ভেঙেই কাজ বা দায়িত্বে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ার বদলে, স্লো মর্নিং এমন কার্যকলাপ করার সুযোগ দেয়, যা মন ও শরীরকে পুষ্ট করে। এসবের মধ্যে আছে জার্নাল লেখা, ধ্যান অথবা ধীরেসুস্থে নাশতা করা। তবে এটি মেনে চলার জন্য আপনাকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে।
এর মানে হলো, আপনার অফিস ৯টায় শুরু হলে হয়তো সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে ওঠেন। তাহলে আপনাকে সকালজুড়ে তাড়াহুড়ো করে গোসল, নাশতা তৈরি, খাওয়া এবং অন্য সব কাজ শেষ করে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। তবে ধীরগতির সকাল বা স্লো মর্নিং রুটিন মেনে চলতে হলে এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় গতিতে দিন শুরু করতে, আপনাকে কমপক্ষে ৬টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে।
স্লো মর্নিং রুটিনের সুফল
গবেষণায় দেখা গেছে, সকালে মননশীল কার্যকলাপে অংশ নিলে সারা দিন জ্ঞানীয় কার্যকারিতা এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বাড়ে। ধীর ও স্থির গতিতে দিন শুরু করলে মস্তিষ্ক, শরীর এবং মন ধীরে ধীরে আরাম এবং দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। এটি দৈনন্দিন কার্যকলাপে শান্ত ভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে। এতে সামগ্রিক চাপ কমে এবং অনেক ভালো কাজ করা যায়। মানসিক অস্থিরতা ও ক্লান্তি কমে।
স্লো মর্নিং কীভাবে শুরু করবেন
ধীরেসুস্থে সকালের রুটিন মেনে চলতে হলে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় রাখতে হবে। অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? যেখানে ঘুম থেকে ওঠার এক ঘণ্টার মধ্য়ে সব কাজ সেরে অফিসের পথে দৌড়াতে হয়, সেখানে ৪ বা ৫ ঘণ্টা তো বিরাট ব্যাপার। তবে স্লো মর্নিং রুটিনে ব্যায়াম থেকে শুরু করে ধ্যান, সংবাদপত্র পড়া, গান শোনা, ত্বকের যত্ন—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। ফলে এইটুকু সময় তো আপনার জীবন পেতেই পারে। স্লো মর্নিং রুটিনে যেসব অভ্যাস সাধারণত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা একনজরে দেখে নিন।
আগে ঘুম থেকে উঠুন
স্লো মর্নিংয়ের প্রথম পদক্ষেপ হলো, সকালে নিজেকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। এর মর্ম হলো, সকালটা তাড়াহুড়ো বা তড়িঘড়ি না করে ধীরে সুস্থে শুরু করবেন। এর জন্য জুতসই শব্দ ব্যবহার করতে গেলে বলতে হয়, মাইন্ডফুলি সকালটা শুরু করুন। প্রতিটি কাজই স্বাভাবিক গতিতে উপলব্ধিসহকারে করুন। শ্রবণ ও ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে সক্রিয় রাখুন। আর এই সবকিছুর জন্যই একটু আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে। নয়তো সময়ে টান পড়ে যেতে পারে।
ঘুম ভেঙেই মোবাইল ফোন হাতে নেবেন না
এ যুগের সাধারণ অভ্যাস হলো ঘুম ভেঙেই স্মার্টফোনটি হাতে নেওয়া। এতে আপনার সময় কখন যে চুরি হচ্ছে, নিজেও টের পাচ্ছেন না। ফলে তাড়াহুড়ো করে সকালের সব কাজ সারতে হচ্ছে। তা ছাড়া সকালে উঠেই যাঁরা আগে স্মার্টফোনে চোখ রাখেন, তাঁদের মধ্য়ে স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটি বেশি দেখা দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করা ছাড়া যদি আপনি দিন শুরু করতে পারেন, তাহলে অনেকটাই শান্ত থাকতে পারবেন। অসংখ্য গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোন ঘুমের মান খারাপ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ ও চাপের অন্যতম কারণ।
মননশীল কাজ দিয়ে দিন শুরু করুন
স্ট্রেচিং, যোগব্যায়াম, গভীর শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া, শান্ত গান শোনা, বই পড়া, প্রার্থনা করা ইত্যাদি সকালের রুটিনে যোগ করুন। স্লো মর্নিং শুরু করার জন্য ইতিবাচক সুর তৈরি করতে এগুলো বেশ কার্যকর।
পুষ্টিকর নাশতা উপভোগ করুন
স্বাস্থ্যকর ও সহজে হজমযোগ্য নাশতা রাখুন সকালে; পাশাপাশি সারা দিন যেন শরীরে শক্তি বজায় থাকে, এমন খাবারও যেন থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ডিম, সরিষা, কারিপাতা ও শাকসবজি দিয়ে ভাজা ভাত, দই-চিড়া-গুড় কিন্তু সকালের নাশতা হিসেবে ভালো। পেটও ভরে, স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। এ ছাড়া সবজি, ডাল ও রুটি দিয়েও নাশতা সারতে পারেন। সঙ্গে থাকতে পারে ডিম সেদ্ধ। বাদাম, গাজর, খেজুরসহ সুজির হালুয়া খেলেও উপকার পাওয়া যায়। সহজ নাশতা হিসেবে রাখতে পারেন প্যানকেক। কিন্তু এসব খাবার কেবল পাতে রাখলেই হবে না, সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে খেতে হবে। খাবারের রং, গন্ধ ও স্বাদ উপভোগ করুন। এতে সকালটা আরও সুন্দর মনে হবে।
একটি করে ভালো চর্চা যোগ করুন
সকালে অন্তত একটি ভালো চর্চা যোগ করুন। তা হতে পারে ত্বক ভালোভাবে পরিষ্কার করে ময়শ্চারাইজ করা, গাছে পানি দেওয়া, পোষা প্রাণীটির যত্ন নেওয়া কিংবা ঘর গোছানো। যে কাজগুলোয় আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাবেন। প্রতিদিন সকালে করতে পারবেন, তেমন একটি অভ্যাসই তৈরির চেষ্টা করুন। এতে সকালগুলো অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে।
রোদ গায়ে মাখুন
সকালের নরম রোদ গায়ে মাখুন। কেবল ভিটামিন ‘ডি’র জন্য ১৫ মিনিট বসে থাকা নয়। রোদের আলোকচ্ছটা ছুঁয়ে দেখুন, এর রংটা আরও উপলব্ধির চেষ্টা করুন, উষ্ণতা অনুভব করুন। অনুভব করুন সকালের সোনারোদ গায়ে মাখার পর শরীরের প্রতি কোষই জেগে উঠেছে নতুন করে। আর এই অনুভূতির জন্য পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। সেই সময়টা যেন বরাদ্দ রাখতে পারেন। তাই আগের রাতে একটু আগেভাগেই ঘুমাতে যান।
সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে ও অন্যান্য