বিমানের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে! এই জানালার পাশের সিটে বসতে অনেকে সহযাত্রীর সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তবে মাথা ঠান্ডা রেখে ভালোভাবে অনুরোধ করলে সহযাত্রী অনেক সময় সদয় হলেও হতে পারেন। আবার অনেকে টিকিট নেওয়ার সময় জানালার পাশের সিটটি চেয়ে নেন। যাঁরা নিয়মিত বিমান ভ্রমণ করেন, তাঁদের অনেকের একটি অভিজ্ঞতা আছে, তা হলো, উড্ডয়ন বা অবতরণের ঠিক আগে কেবিন ক্রুরা অনুরোধ করেন জানালার শেড তুলে দিতে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা কেন করতে হয়। বিশেষ করে, যখন কেউ ভেতরে আরামের জন্য বা ঘুমানোর চেষ্টায় শেড নামিয়ে রাখেন, তখন এই নিয়ম কিছুটা বিরক্তিকর মনে হতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ নিয়মটির পেছনে রয়েছে যাত্রীদের নিরাপত্তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ।
দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ঝুঁকি
বিমানের জানালার শেড খোলা রাখার প্রধান কারণটি হলো নিরাপত্তা। বোয়িংয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনা অত্যন্ত বিরল হলেও বেশি দুর্ঘটনা ঘটে উড্ডয়ন ও অবতরণের সময়। ক্রুজিং উচ্চতায় বিমান বাতাসে বেশি সময় কাটায়। সেই ধাপে মাত্র ১০ শতাংশ মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে, অবতরণের ধাপে মাত্র ১ শতাংশ সময় ব্যয় হলেও এ সময় ৩৭ শতাংশ মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণে বিমান সুরক্ষার উন্নতির বেশির ভাগ মনোযোগ এই দুটি ধাপের ওপর দেওয়া হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দুর্ঘটনা বেশি ঘটার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমটি হলো, কম প্রতিক্রিয়া সময়। উড্ডয়ন, অবতরণ বা অ্যাপ্রোচের সময় বিমান মাটির কাছাকাছি থাকে। যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, পাইলটদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য সময় অনেক কম থাকে। দ্বিতীয় কারণ, এ সময় রানওয়েতে অন্যান্য বিমান, যানবাহন, দালানকোঠা, কখনো কখনো প্রাণীসহ বিভিন্ন বাধা থাকে। এ ছাড়া এ সময় পাইলটদের অনেক বেশি কাজ করতে হয়। ফলে কেবল অটো পাইলটের ওপর নির্ভর করা যায় না। আরও একটি কারণ হলো, বিমান সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ হাজার ফুটের মধ্যে ভ্রমণ করে। কারণ, এটি মেঘ ও ঝড়-ঝঞ্ঝার স্তর থেকে উঁচুতে থাকার জন্য উপযুক্ত। কিন্তু ওঠানামার সময় বিমানকে এই স্তর ভেদ করে যেতে হয়।
জরুরি অবস্থায় দৃষ্টিসীমা বজায় রাখা
সিরাস অ্যাভিয়েশন সার্ভিসের পাইলট রক স্যাডির মতে, জানালার শেড ওপরে তুলে রাখার উদ্দেশ্য হলো যাত্রী ও ক্রু উভয়ের জন্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতা নিশ্চিত করা। যদি কোনো জরুরি অবস্থা তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে জানালার শেড খোলা থাকলে বেশ কিছু সুবিধা আছে। যেমন জানালা খোলা থাকলে ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ও জরুরি সেবার মানুষেরা বিমান থেকে বের হওয়ার আগে বাইরে আগুন, ধ্বংসাবশেষ বা পানির মতো পরিস্থিতি চাক্ষুষ মূল্যায়ন করতে পারেন। পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ হলে কখনো কখনো বিমানের ভেতরে থাকা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার চেয়ে বেশি নিরাপদ। জানালার শেড বন্ধ থাকলে এই মূল্যায়ন প্রায় অসম্ভব। শুধু তাই নয়, মাটিতে থাকা সহায়তাকারীরা বাইরে থেকে ভেতরের পরিস্থিতি দেখতে পান এবং সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
নেমে যাওয়ার আগে চোখের মানিয়ে নেওয়া
নিরাপত্তা ছাড়াও এর আরও একটি ব্যবহারিক কারণ রয়েছে। স্কাই ওয়েস্ট এয়ারলাইনসের ক্যাপ্টেন অ্যাডাম কোহেন জানান, অবতরণের আগে জানালার শেড খুলে দিলে বিমান থেকে নামার আগে যাত্রীদের চোখ বাইরের আলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। যদিও মানুষের চোখ অন্ধকারের তুলনায় আলোর সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয়। তবুও এটি তাৎক্ষণিক হয় না। তবে, রাতের বেলা বা খুব সকালে উড্ডয়ন ও অবতরণ হলে ক্রুরা কেবিনের আলো কমিয়ে দেন, যাতে যাত্রীদের চোখ আগে থেকে অন্ধকারের সঙ্গে মানিয়ে নেয়।
ক্রুর নির্দেশই শেষ কথা
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, মাঝ আকাশে জানালার শেড খোলা বা বন্ধ রাখার অধিকার কার। কারও মনে হয় এই অধিকার যে যাত্রী জানালার পাশে বসেছেন তাঁর। আবার অনেকে বলতে পারেন, এই দায়িত্ব পুরো সারির যাত্রীদের। আসলে এটি কারও ব্যক্তিগত অধিকার বা দায়িত্ব নয়। কেবিন ক্রু বা ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের নির্দেশই এখানে চূড়ান্ত। যেকোনো পরিস্থিতিতে ক্রু যখনই জানালার শেড খোলা বা বন্ধ করতে বলবেন, যাত্রীদের তা মেনে চলা অত্যাবশ্যক। কারণ, ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সপোর্টেশন অনুযায়ী, ক্রু সদস্যের নির্দেশ মানতে ব্যর্থ হলে সেটি ফেডারেল অ্যাভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আইন লঙ্ঘনের শামিল হতে পারে। এ জন্য জরিমানা হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
সূত্র: ট্রাভেল+লিজার