বাংলাদেশে ক্যারিয়ার মানে অনেক পরিবারের চোখে কেবল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারকে মনে করা হয়। মা-বাবার স্বপ্ন, সমাজের আশা, আত্মীয়দের উপদেশ—সবই যেন ঘুরেফিরে এ দুটি পেশায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, পৃথিবী আর সে জায়গায় নেই। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, মানুষের চাহিদাও বদলেছে। আজকের পৃথিবীতে এমনসব পেশার উদ্ভব হচ্ছে, যেগুলোর নাম ১০ বছর আগেও শোনা যায়নি। চলুন দেখে নেওয়া যাক নতুন যুগের এমন ১০টি সম্ভাবনাময় পেশা, যেখানে আগামী দিনের বাংলাদেশ খুঁজে পেতে পারে নিজের ভবিষ্যৎ।
ডেটাবিজ্ঞানী
ডেটা এখন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেটে ক্লিক, সার্চ, কেনাকাটা, ভ্রমণ, ভোট যা করছে—সবই জমছে বিশাল তথ্যভান্ডারে। এ তথ্যকে অর্থপূর্ণ করে তুলছেন যাঁরা, তাঁরা হচ্ছেন ডেটাবিজ্ঞানী। তাঁরা তথ্য থেকে বের করেন ভবিষ্যতে কোন পণ্য বেশি বিক্রি হবে, কোন রোগ বাড়বে, কোথায় বন্যার ঝুঁকি। একজন দক্ষ ডেটাবিজ্ঞানী একই সঙ্গে বিশ্লেষক, প্রোগ্রামার এবং গল্পকার, যিনি সংখ্যার ভেতর লুকিয়ে থাকা জীবনের গল্পটি বুঝতে পারেন। দেশেও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং বিশেষজ্ঞ
যে যুগে যন্ত্র নিজের মতো করে শিখছে, চিনছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে যুগের কেন্দ্রে রয়েছে এআই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন কেবল গুগল বা আমাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি ঢুকে পড়েছে চিকিৎসা, কৃষি, শিক্ষা এমনকি আইন পর্যন্ত। এআই বিশেষজ্ঞদের কাজ হলো মেশিনকে শেখানো, কীভাবে ডেটা থেকে শেখা যায়। দেশেও এ ক্ষেত্র ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে।
টেলিমেডিসিন ও স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ঘটছে বড় পরিবর্তন। এখন ডাক্তার আর রোগীর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দিচ্ছে প্রযুক্তি। গ্রামের মানুষ ভিডিও কলেই পাচ্ছেন শহরের চিকিৎসক। অনলাইনের মাধ্যমে তাঁদের রোগের রিপোর্ট পৌঁছে যাচ্ছে নিজেদের হাতে। এই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন টেলিমেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসা এবং প্রযুক্তি দুটো ভাষাই তাঁরা জানেন। স্বাস্থ্য খাতে এখন তৈরি হচ্ছে ওয়্যারেবল ডিভাইস, হেলথ অ্যাপ, অ্যালগোরিদমভিত্তিক রোগ নির্ণয়—এসবের পেছনেও কাজ করছেন নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিবিদেরা।
ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্স ম্যানেজার
যে যুগে বাজার মানেই অনলাইন, সে যুগে বিপণনের ভাষাও বদলে গেছে। একটি ব্র্যান্ড এখন টিকে থাকে ‘অ্যালগোরিদম’ আর ‘অ্যানালাইটিকস’-এর ওপর। সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট, সার্চ রেজাল্ট, ইউটিউবের ভিডিও সবকিছুই আজ এক বিশাল মার্কেটিং জগৎ। ডিজিটাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞরা বুঝে নেন দর্শক কোথায়, কখন, কীভাবে ভাবছে। তাঁরা তৈরি করেন অনলাইন বিক্রির কৌশল, ডেটাভিত্তিক বিজ্ঞাপন এবং ব্র্যান্ড পরিচিতি। দেশে ই-কমার্সের যে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটছে, তা এ খাতকে আগামী দিনের অন্যতম শক্তিশালী কর্মক্ষেত্রে পরিণত করবে।
কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও সোশ্যাল মিডিয়া স্ট্র্যাটেজিস্ট
একসময় লেখক মানে ছিল বইয়ের পাতা; এখন লেখক মানে হতে পারে ইউটিউবের পর্দা বা ইনস্টাগ্রামের রিল। ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটররা আজ এক নতুন সমাজ তৈরি করছেন। যেখানে বিনোদন, শিক্ষা, তথ্য, মতামত—সবই একসঙ্গে প্রবাহিত হয়। তাঁরা শুধু ভিডিও বানান না, বরং তৈরি করেন প্রভাব। একটি ভালো কনটেন্ট কখনো প্রচলিত সংবাদকেও ছাড়িয়ে যায়, ছুঁয়ে ফেলে লাখো মানুষকে। এ পেশা এখন শুধু সৃজনশীলতার জায়গা নয়, এটা এক পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক খাত।
কৃষিপ্রযুক্তি ও খাদ্য উদ্ভাবন বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এই কৃষিও এখন প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে। স্মার্ট সেচব্যবস্থা, ড্রোনে জমির পর্যবেক্ষণ, সেন্সর দিয়ে মাটির বিশ্লেষণ—এসবই এখন বাস্তবতা। এ খাতে কাজ করছেন অ্যাগ্রিটেক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের চেষ্টায় কৃষি হচ্ছে আধুনিক, উৎপাদন হচ্ছে দক্ষ, আর কৃষক পাচ্ছেন প্রকৃত দামের নিশ্চয়তা। আগামী দিনে খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে এ পেশার গুরুত্ব বহুগুণে বাড়বে।
ডিজিটাল নীতি, নৈতিকতা ও সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ
প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, ততই বেড়ে যাচ্ছে নৈতিকতা ও আইনের প্রশ্ন। ডেটা গোপনীয়তা, অনলাইন হয়রানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার—এসবের সমাধানে দরকার এমন মানুষ, যাঁরা বোঝেন আইন ও প্রযুক্তি দুই-ই। ডিজিটাল রেগুলেশন বিশেষজ্ঞরা এই নতুন বিশ্বের শৃঙ্খলা তৈরিতে কাজ করেন। এ পেশা হয়তো কম আলোচিত, কিন্তু এটি ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর একটি হয়ে উঠছে।