১৮ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস। প্রতিবছর এ দিবসটি পালনের জন্য কিং সালমান আরবি ভাষা একাডেমি ও ইউনেসকোর যৌথ উদ্যোগে একটি স্লোগান বা আলোচনার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০২৫ সালে আরবি ভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আরবি ভাষার উদ্ভাবনী সম্ভাবনা: ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাষাগত ভবিষ্যতের জন্য নীতি প্রণয়ন ও চর্চার পথ উন্মুক্তকরণ’।
আজকের বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল। প্রযুক্তি, বিশ্বায়ন ও বহুভাষিক সমাজব্যবস্থা ভাষার চরিত্র বদলে দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ধারায় আরবি ভাষাও এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে এটি কোরআনের ভাষা; প্রাচীন জ্ঞান ও সাহিত্যভান্ডারের ধারক; অন্যদিকে আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলাও তার জন্য জরুরি। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য এই দ্বৈত বাস্তবতাকে সামনে রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য হলো, এমন কার্যকরী সমাধান ও মূলনীতি আবিষ্কার করা, যা দ্রুত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ডিজিটাল পরিবর্তনের আলোকে আরবি ভাষার ভবিষ্যৎকে পুনর্গঠন করবে, যা শিক্ষা-প্রযুক্তি কর্তৃক কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে আরবিকে আরও প্রভাবশালী ভূমিকা পালনে সক্ষম করে তুলবে। এই বছরের প্রতিপাদ্যে উদ্ভাবনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আধুনিক সময়ে পরিবর্তিত সামাজিক কাঠামো ও প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে আরবি ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার উপায় খোঁজা এই প্রতিপাদ্যের লক্ষ্য।
ডিজিটাল যুগে ভাষার বিকাশ অনেকাংশেই নির্ভর করে প্রযুক্তিতে তার উপস্থিতির ওপর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশনে আরবি ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল কোরআন, তাজবিদ শেখার অ্যাপ ও আরবি অভিধান নতুন প্রজন্মের কাছে আরবি শিক্ষাকে সহজ ও আকর্ষণীয় করে তুলছে। আরবির এই চলমান অগ্রগতি ইতিবাচক। তবে জরুরি বিষয় হলো, এই অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তাকে প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করতে হবে এবং এর সক্ষমতা অটুট রাখার জন্য দরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া শিক্ষানীতিতে আরবি ভাষার গুরুত্ব নিশ্চিত করা, প্রশাসন, আদালত ও গণমাধ্যমে আরবির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং গবেষণা ও অনুবাদ কার্যক্রমে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণের প্রস্তাবও থাকছে এবারের প্রতিপাদ্যে। নীতির পাশাপাশি বাস্তব প্রয়োগের প্রতিও গুরুত্ব থাকছে এখানে। শ্রেণিকক্ষে আরবি শেখানোর কার্যকরী পদ্ধতি এবং অভিবাসী, প্রতিবন্ধী, দৃষ্টিহীনসহ সর্বস্তরের অনারবদের জন্য সহজ পাঠ্যক্রম প্রণয়নের কথাও থাকছে এতে।
সবশেষে রয়েছে ব্যাপক অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের কথা। আরবি ভাষা যেন শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং নারী-পুরুষ, বয়স্ক-শিশু, আরব-অনারব সবার মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহুভাষিকতার সঙ্গে আরবির সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়, এর জন্য দরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন প্রয়াস। চলতি বছরের প্রতিপাদ্যে এ বিষয়গুলোই তুলে ধরতে চাওয়া হয়েছে।
এ বছর সৌদি আরবে বিশ্ব আরবি ভাষা দিবসের আয়োজন হয়েছে বাদশাহ সুলতান বিন আবদুল আজিজ সেবা সংস্থা ও ইউনেসকোর যৌথ উদ্যোগে এবং ইউনেসকোতে কর্মরত সৌদি সরকারের প্রতিনিধিদলের সমন্বয়ে। এ বিষয়ে বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এ বছরের আরবি ভাষা দিবসের আয়োজন আরবি ভাষার সেবা ও বিশ্বব্যাপী আরবির প্রচার বৃদ্ধিকারী উদ্যোগসমূহের প্রতি বাদশাহ সুলতান বিন আবদুল আজিজ সেবা সংস্থার সর্বাত্মক প্রতিশ্রুতির পরিচয় বহন করে।’ (সূত্র: আর-রিয়াদ)
এ বছরের প্রতিপাদ্য ঘোষণার পর ইউনেসকো তাদের ওয়েবসাইটে বিবৃতি দিয়েছে, ‘দ্রুতগামী ডিজিটাল পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মধ্যে এবারের বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে এবারের আয়োজন এমন কিছু আলোচনা তুলে ধরবে, যেখানে শিক্ষাব্যবস্থা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ও সাধারণ কথাবার্তায় আরবির উপস্থিতিকে আরও শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে যে বহুভাষিক সমাজে ভাষা-শিক্ষামাধ্যম সীমিত, সেখানে আরবির উপস্থিতি সহজ ও অবারিত করবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই ভাষার নানামাত্রিক চর্চা ও অনুশীলন, অন্য ভাষাসমূহের সঙ্গে একে পূর্ণ সমতার অবস্থানে উন্নীতকরণ এবং বিভিন্ন দেশ ও সমাজে স্বকীয়তা ঠিক রেখে আরবির প্রবেশায়নের পথ-পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হবে।’
ইউনেসকো আরও জানিয়েছে, ‘বিশ্ব আরবি ভাষা দিবসের আয়োজনটি আরবি ভাষা নিয়ে পরস্পরে কথোপকথন, চিন্তা ও ভাব বিনিময়ের সুযোগ। পাশাপাশি আরবি ভাষার বৈশ্বিক অবস্থানের মূল্যায়ন ও এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অংশ।’
আমাদেরও প্রত্যাশা, বাংলাদেশে আরবি ভাষা চর্চাকে আরও বেগবান করতে হবে। আরবি ভাষা ব্যাপককরণের ক্ষেত্রে যত সংকট, সব নিরসন করতে হবে। এই ভাষার অগ্রগতি সাধনের জন্য যথাযথ পথ ও পন্থা তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে, আরবি ভাষা শিক্ষাদানের জগতে আমাদের আরেকটু সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। অনারবদের আরবি ভাষা পাঠদান পদ্ধতি ও কার্যকরী সিলেবাসের প্রয়োগ আমাদের শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষাকে সহজ করবে। কওমি ও আলিয়া উভয় শিক্ষাব্যবস্থাতেই আরবির সিলেবাসকে প্রাচীন ও আধুনিক আরবির সমন্বয়ে জীবন্ত ও প্রায়োগিক হিসেবে পুনর্গঠন করা জরুরি।
সবশেষে আমাদের আহ্বান, আরবি ভাষাকে দিবসকেন্দ্রিক উদ্যাপন না করে একে জীবনব্যাপী রূপ দেওয়া দরকার। মুসলমান মাত্রই আরবি ভাষার মুখাপেক্ষী। আমাদের জিকির-আজকার, দোয়া-দরুদ থেকে নিয়ে প্রায় প্রতিটি ইবাদতেই আরবির প্রয়োজন হয়। আরবি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক ভাষা। তাই ‘আরবি ভাষা দিবস’ শিরোনামে একটি দিন নির্ধারিত থাকলেও বাস্তবিক জীবনে আমাদের প্রতিটি দিনই আরবি ভাষা দিবস।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ