অনেককাল আগে—যখন হরফের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়নি, তখন পরস্পরে ভাববিনিময় চলত বস্তুর ছবি এঁকে। গাছের পাতায়, পশুর চামড়ায় বা প্রস্তরখণ্ডে। যুগের পরিবর্তনে ভাব প্রকাশের মাধ্যমেও এসেছে পরিবর্তন। ছবি থেকে সংকেত, সংকেত থেকে বর্ণকে গ্রহণ করেছে মানুষ। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষার বর্ণমালাই ঐতিহাসিক এ নিয়মের ভেতর দিয়ে বরণ করেছে আজকের আধুনিক রূপ।
ভাষাতাত্ত্বিকদের সর্বসম্মত মত হলো, আরবি হরফের মূল উৎস সেমেটিক লিপিগোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর অন্যতম প্রাচীন লিপি হলো ফিনিশীয় লিপি। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত এই ফিনিশীয় লিপি থেকে পরবর্তী সময়ে জন্ম হয় আরমীয় লিপির এবং এ লিপিরই একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নাবাতীয় লিপি। নাবাতীয় গোষ্ঠীর লোকজন বাস করত বর্তমান জর্ডান, উত্তর আরব ও হিজাজ অঞ্চলে এবং তাদের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির কারণে নাবাতীয় লিপির ব্যবহার ছিল বহুল। জর্ডানের পেট্রা নগরীর পুরোনো দেয়ালে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে নাবাতীয় লিপির নমুনা।
নাবাতীয় লিপির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এর প্রায় সব বর্ণই পরস্পর মিলিয়ে লেখা হতো। একটি বর্ণ শব্দের শুরু, মাঝে ও শেষে তিন অবস্থায় তিন রূপ ধারণ করত। এর বর্ণগুলোর কোথাও কোনো নুকতা বা বিন্দুর ব্যবহার ছিল না। একে লেখা হতো ডান থেকে বাঁয়ে। পরে এই বিষয়গুলো আরবি হরফের মৌলিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় এবং এর থেকেই আরবি হরফের প্রাথমিক কাঠামো গড়ে ওঠে।
আরবের জাহেলি যুগেই আরবি ভাষা পূর্ণতার শিখরে আরোহণ করে। আরবের কবি ও বক্তাদের সৃজনশীল সাহিত্য এর উজ্জ্বল প্রমাণ। তবে জাহেলি যুগে লেখার চর্চা ছিল সীমিত। এর মধ্যে কিছু শিলালিপি, চুক্তিপত্র ও কবিতার অংশে আরবি লিপির প্রাথমিক নিদর্শন পাওয়া যায়। এই সময়ের লিপিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হিজাজি লিপি। এই লিপির ধরন একটু সরল। প্রাথমিক কোরআনের কিছু পাণ্ডুলিপিতে এর নমুনা দেখা যায়। দ্বিতীয়টি কুফি লিপি। এটি অপেক্ষাকৃত কোনাকুনি ধরনের। পরে কোরআন লিপিবদ্ধকরণে এই লিপি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।
ইসলাম আগমনের পর আরবি হরফ এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে আরবি লিপিতে বিন্দু ও হরকতের ব্যবহার ছিল না। নুকতা না থাকার ফলে একটি হরফকে (যেমন: বা-তা-ছা অথবা হা-খা-জিম) বিভিন্নভাবে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতো। আবার হরকতের অনুপস্থিতিতে শব্দের প্রকরণ ও বাক্যের ব্যাকরণিক সমস্যা সৃষ্টি হতো। কাজেই কোরআন সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য আরবি লিপির মানোন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। হরকতের জটিলতা নিরসনের জন্য হিজরি প্রথম শতাব্দীতেই আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের প্রণেতা আবুল আসওয়াদ দুয়ালি নুকতার ব্যবহার শুরু করেন। জবরের জন্য হরফের ওপর এক নুকতা, জেরের জন্য নিচে এক নুকতা, পেশের জন্য হরফের আগে এক নুকতা ও তানবিনের জন্য দুই নুকতার প্রচলন ঘটান তিনি। হরকতের সংকট থেকে বেরিয়ে আসা এর মাধ্যমে কিছুটা সহজ হয়।
বাকি থাকে সাদৃশ্যপূর্ণ বর্ণগুলো আলাদা করার বিষয়। এ সমস্যা দূর করার জন্য আবুল আসওয়াদ দুয়ালির ছাত্র বিখ্যাত আরবি ব্যাকরণবিদ নাসর ইবনে আসিম ও ইয়াহইয়া ইবনে ইয়ামুর এগিয়ে আসেন এবং এক রকম দুইটি হরফের একটিকে নুকতাযুক্ত ও অপরটিকে নুকতাবিহীন রেখে অথবা একাধিক নুকতার ব্যবহার করে হরফ চেনার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
উভয় ক্ষেত্রে নুকতা ব্যবহারের ফলে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ সময় বিখ্যাত আরবিবিদ, আরবিতে প্রথম অভিধান প্রণেতা ও ছন্দশাস্ত্রের আবিষ্কারক খলিল আহমাদ ফারাহিদি হরকতের জন্য জবর, জের ও পেশের ব্যবহার শুরু করেন এবং এই পদ্ধতিই ব্যাপকভাবে আরবি লিপিতে প্রসার লাভ করে। আধুনিক যুগে আরবি লিপির জন্য আরবি ভাষা একাডেমিসমূহের প্রচেষ্টায় ‘ইমলা’ নামে আরবি বানানরীতি প্রণীত হয়েছে এবং সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত মূলনীতির আওতায় আরবি নুসুস বা টেক্সট লেখা হচ্ছে।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ বাংলাদেশ