উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ জেলা নানা ইতিহাস ও ঐতিহ্যে বিখ্যাত। এই জেলার শাহজাদপুর থানা প্রাচীন প্রত্নতত্ত্বে সমৃদ্ধ। মুসলিম আমলে শাহজাদপুর ইউসুফশাহি পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউসুফ শাহের নামানুসারে স্থানটির নামকরণ করা হয় শাহজাদপুর। এই শহরের উপকণ্ঠে করতোয়া নদীর পারে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে অনন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন শাহজাদপুর দরগাহ মসজিদ, যা স্থানীয়দের কাছে পরিচিত বড় মসজিদ নামে। কয়েক শতাব্দী ধরে অনন্য মসজিদটি এ অঞ্চলের ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। এ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস!
শাহজাদপুর শহরের দরগাহপাড়ায় অবস্থিত প্রাচীন এ মসজিদটি স্থানীয় মুসলিমদের ধর্মীয় কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত স্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত। রাজশাহী বিভাগের এই অঞ্চলে ইসলামিক স্থাপত্য ও সংস্কৃতির মর্যাদায় মসজিদটি রয়েছে প্রথম সারিতে। মসজিদের পাশেই আরও দুটি স্থাপনা রয়েছে—হজরত মখদুম শাহ দৌলা ইয়েমেনি (রহ.)-এর মাজার এবং শামসুদ্দিন তাবরিজি (রহ.)-এর মাজার।
কথিত আছে, হজরত মখদুম শাহ দৌলা ইয়েমেনি (রহ.) ইয়েমেন থেকে শাহজাদা জীবনের সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে প্রথমে বুখারা শহরে পৌঁছান। সেখানকার বিখ্যাত ওলি হজরত জালাল উদ্দিন বুখারি (রহ.)-এর সঙ্গে কিছু সময় কাটানোর পর যাত্রা শুরু করে বাংলার এ অঞ্চলে আসেন। ধারণা করা হয়, পনেরো শতকের এই প্রখ্যাত সুফি সাধক মসজিদটি নির্মাণ করেন।
একাধিক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির ছাদ তিন সারিতে মোট ১৫টি গম্বুজ দিয়ে আচ্ছাদিত। এটি এক কক্ষের মসজিদ, যা উত্তর-দক্ষিণে প্রশস্ত। পূর্ব দেয়ালে পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে—প্রতিটি ২.১ মিটার উঁচু ও ১.৮ মিটার চওড়া। ভেতরে আটটি কালো পাথরের সুদৃঢ় স্তম্ভ রয়েছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ছাদ। কুচকুচে কালো, মসৃণ এই স্তম্ভগুলোকে স্থানীয় অনেকেই কষ্টিপাথর বলে দাবি করে থাকেন।
বাংলার সুলতানি আমলের মসজিদগুলোর বৈশিষ্ট্য এখানে সহজেই চোখে পড়ে। পুরু দেয়াল, খিলানাকৃতির দরজা-জানালা, টেরাকোটার অলংকরণ দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। এ মসজিদের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্য হলো, এর সাত ধাপবিশিষ্ট গম্বুজযুক্ত দ্বিতল মিম্বার, যা অন্য কোনো মসজিদে তেমন দেখা যায় না। শাহজাদপুরের সুপ্রাচীন দরগাহ মসজিদ এ দেশের ইসলামিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এটি শুধুই কোনো পুরাকীর্তি নয়, বরং প্রাচীন ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাহক, এক জীবন্ত ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এটি আজও স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এই মসজিদের মাধ্যমে আমরা মধ্য যুগীয় ইসলামি সভ্যতার সোনালি অতীত জানতে পারি। জানতে পারি সেকালের মুসলিম স্থাপত্যকলা ও তার সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই আধুনিক যুগের করাল গ্রাসে যখন অনেক প্রাচীন স্থাপত্য ধ্বংস ও বিলুপ্তির পথে, তখন মসজিদটি তার অতীত জৌলুশ ধারণ করে আজও দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে, আপন মহিমায়। জানান দিয়ে যাচ্ছে আমাদের পূর্বসূরিদের গৌরবময় অতীত। পৌঁছে দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের কাছে কালগর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। রক্ষা করে চলেছে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ। প্রাচীন এই মসজিদটি তাই শুধু শাহজাদপুরের সম্পদ নয়, সমগ্র বাংলা মুলুকের অমূল্য সম্পদ। এর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ ও অব্যাহত সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সোনালি অতীত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সহজেই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।