যুদ্ধবিরতির পর ধ্বংসস্তূপে ফিরতে শুরু করেছেন গাজার বাসিন্দারা। ধ্বংসস্তূপ থেকে যেসব জিনিসপত্র উদ্ধার করা যাচ্ছে, সেসব সংগ্রহ করছেন আর পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছেন অনেকে। তবে এই নতুন শুরুর চেষ্টার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে ইসরায়েলিদের বিস্ফোরকবাহী রোবট।
২০২৪ সালের মে মাসে জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরে প্রথমবারের মতো এগুলো ব্যবহার করে ইসরায়েলি সেনারা।
জাবালিয়া, শেখ রাদওয়ান, আবু ইস্কান্দার ও অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারা ফিরে এসে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করছিলেন এটা নিশ্চিত জেনেই যে—এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে রয়েছে অবিস্ফোরিত রোবট বোমা। তবে কোথায় কোথায় আছে, জানেন না তাঁরা। আর সামনে পেলেও কীভাবে নিস্ক্রিয় করবেন বা এ থেকে নিজেদের কীভাবে রক্ষা করবেন, সেটিও জানেন না। এ কারণে অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় ছেয়ে গেছে তাঁদের মন।
গত ১ সেপ্টেম্বর ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুদ্ধবিরতির আগে এই রোবটের ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। এগুলো দিয়ে প্রতিদিন গাজা ও জাবালিয়ায় প্রায় ৩০০টি আবাসিক ইউনিট ধ্বংস করা হয়েছিল।
এই রোবটগুলো একধরনের সাঁজোয়া যান। ইসরায়েলি সেনারা এগুলোতে বিস্ফোরক ভরে দিয়ে তারপর সাঁজোয়া বুলডোজার ব্যবহার করে সেগুলোকে নির্দিষ্ট স্থানে পাঠিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাত।
গাজা সিটি সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল আল-জাজিরাকে বলেন, এই রোবটে কতটুকু বিস্ফোরক ছিল, তা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এটি কতটা সময় টিকে থাকে, তা-ও জানা নেই।
তবে এর ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা স্পষ্ট, বলেন বাসাল। তিনি রোবটের ‘কিল রেডিয়াস’ উল্লেখ করে বলেন, এটি প্রায় ৫০০ মিটার পর্যন্ত ধ্বংস করে দিতে পারে।
গত নভেম্বরের স্মৃতিচারণ করেন জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের ২২ বছর বয়সী শরিফ সাদি। তিনি বলেন, ‘শৈশব থেকে বিমান হামলা, কামান ও রকেটের শব্দ অনেক শুনেছি। কিন্তু নতুন ওই আওয়াজ শুনে মনে হলো, যুদ্ধের সব শব্দের সঙ্গে এখনো পরিচিত হইনি।’
উত্তর গাজায় ইসরায়েলের বর্বর স্থল হামলার সময় ওই ভয়ংকর শব্দ শুনেছিলেন। ওই শব্দ ছিল রোবটগুলোর শব্দ। আর শব্দগুলো শোনার পরপরই রোবটগুলো বিস্ফোরিত হয় আর পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
সাদি বলেন, এই রোবটগুলো একটা এলাকায় প্রবেশ করে আর মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
সেই নভেম্বরের এক সকালের স্মৃতিচারণ করেন সাদি। বলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। ৯ সদস্যের পরিবার আমার। তাদের জন্য কিছু খাবার সংগ্রহের চেষ্টায় ছিলাম। তখন বুলডোজার দিয়ে একটি রোবট আমার এলাকার দিকে নিয়ে যেতে দেখি।’
সাদি বলেন, ‘রোবটটি ব্লকে ঢুকল আর আমি দৌড়ে পালাতে শুরু করলাম।’
সাদি আরও বলেন, ‘আমি প্রায় ১০০ মিটার দৌড়েছিলাম। হঠাৎ নিজেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আবিষ্কার করলাম। বিস্ফোরণটি এত শক্তিশালী ছিল, যারা কাছাকাছি ছিল, তাদের শরীরের কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।’
এর কিছুদিন পরই এক বন্ধুকে হারান তিনি। সাদি বলেন, ‘আমার বন্ধুর শরীর খারাপ ছিল। তাকে কামাল আদওয়ান হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। আমি তার সঙ্গে গিয়েছিলাম। পথে আমরা একটি রোবটকে আসতে দেখলাম। দেখেই আমার বন্ধু আর আমি উল্টো দিকে ছুটলাম।’
সাদি বলেন, ‘এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ ছিল যে আমার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠেছিল। যেখানে শেষবারের মতো আমার বন্ধুকে দেখেছিলাম, সেখানে ফিরে গিয়ে তার চিহ্নও পাইনি। শরীর পুরো নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।’
ইউরো-মেডের প্রতিবেদন অনুসারে, এই ডিভাইসগুলোর নির্বিচারে, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষমতা এটিকে ‘নিষিদ্ধ অস্ত্রের’ শ্রেণিতে ফেলে এবং জনবহুল এলাকায় এগুলোর ব্যবহার ‘যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হয়।
যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বা সরকার কেউই প্রকাশ্যে এই অস্ত্র ব্যবহারের কথা স্বীকার করেনি, তবে কিছু ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে এসব ব্যবহারের খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এ বিষয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আল-জাজিরা কোনো উত্তর পায়নি।
গাজার ফিলিস্তিনি মেডিকেল রিলিফ সোসাইটির পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু আফাশ এ বিস্ফোরকের কথা উল্লেখ করে বলেন, এ বোমার বিস্ফোরণের পরেই এর প্রভাব শেষ হয় না। তিনি বলেন, বিস্ফোরক রোবটগুলো থেকে বের হওয়া বিষাক্ত বাষ্প ও গ্যাস তীব্র দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে, যা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে।
ড. মোহাম্মদ আবু আফাশ আরও বলেন, এগুলোর কারণে শ্বাসকষ্ট ও অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর ঘটনা বারবার ঘটেছে। অনেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেনও। ধারণা করা হয়, এ বিষাক্ত গ্যাসে সিসা ও বিপজ্জনক রাসায়নিক রয়েছে।
৫০ বছর বয়সী তিন সন্তানের মা উম্মে আহমেদ আল-ড্রেইমলি গাজার সাবরার বাসিন্দা। তিনি বিস্ফোরণের পরে বাতাসে ভেসে থাকা গন্ধটিকে ‘বারুদ ও পোড়া ধাতুর মিশ্রণ’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরণের অনেক পরেও আমাদের ফুসফুসে আটকে থাকে এবং শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে।’
উম্মে আহমেদ বলেন, কোনো সতর্কবার্তা বা পালানোর সময় না দিয়েই বিস্ফোরণ ঘটাত ইসরায়েল। বিস্ফোরণের শব্দটি ছিল ভিন্ন।
উম্মে আহমেদ স্মরণ করে বলেন, ‘এর শব্দে ভারী ধাতব গর্জন ছিল, যা হাওয়ায় উড়ন্ত জেট বা ড্রোনের শব্দের মতো নয় বা কাছে চলে আসা ক্ষেপণাস্ত্রের তীক্ষ্ণ শব্দের মতোও ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন আমাদের পায়ের তলার মাটি টেনে নেওয়া হচ্ছে।’
সিভিল ডিফেন্স ও অ্যাম্বুলেন্স মিডিয়া বিভাগের মোহাম্মদ আবু তামুস একাধিকবার রোবট বোমা দেখার কথা জানান।
আবু তামুস বলেন, যখন নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়, সেনাবাহিনী এই রোবটগুলো ব্যবহার করে ভবনগুলোকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়, যাতে আক্রমণকারী যানবাহনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়।
আবু তামুস আরও বলেন, জাবালিয়া ক্যাম্প, বেইত হানুন, তাল আজ-জাতার, বেইত লাহিয়া, তুফফাহ পাড়া, শুজাইয়েয়া, জাইতুন, সাবরা, শেখ রাদওয়ান, আবু ইস্কান্দার, জাবালিয়া ডাউনটাউনসহ পুরো উত্তর গাজায় এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে।
এগুলো ব্যবহারের আগে কোনো রকেটের হুইসেল বা বিমান হামলার সাইরেন বাজে না, শুধু বিস্ফোরণ হয় আর বিশাল সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকে।
আবু তামুস বলেন, একটি অ্যাপার্টমেন্ট বা ভবনে বোমা হামলা করলে দুই বা তিনটি পার্শ্ববর্তী বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু একটা রোবট বোমা পুরো ১০টি বাড়ি ধ্বংস করে দেয়।
ইসরায়েলি সেনারা অবরুদ্ধ করে রাখা জনবহুল এলাকায় এই রোবট বোমাগুলো ব্যবহার করেছিল। ওইসব এলাকায় উদ্ধারকাজ চালাতে উদ্ধারকর্মী বা অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশের অনুমতি দিলেও সেখানে ক্ষয়ক্ষতি এতটা ব্যাপক থাকে যে, কোন এলাকায় বা কোন সড়কে তারা প্রবেশ করছে, বোঝার উপায় থাকে না।
এর আগে গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতির সময় তাল এল-জাতারে একটি অবিস্ফোরিত রোবট বোমা খুঁজে পেয়েছিলেন আবু তামুসেরা। পরীক্ষা করে দেখেন, একটা কনটেইনারে হলুদ পেস্টের মতো পদার্থ, সেটা কী তাঁরা শনাক্ত করতে পারেননি। অন্য সব বিস্ফোরক থেকে এটি আলাদা ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এখন গাজাবাসীরা ফিরছেন। এ নিয়ে আবু তামুস উদ্বিগ্ন, কারণ তিনি অবিস্ফোরিত রোবট দেখেছেন এবং এ ধরনের রোবট নিস্ক্রিয় করতে তিনি ও তাঁর দল কিছুই করতে পারছে না।
আবু তামুস বলেন, ‘আমরা কেবল ওই এলাকাকে টেপ দিয়ে নিষিদ্ধ এলাকা হিসেবে ঘিরে দিতে পারি। এর বাইরে আমাদের হাতে আর কিছুই করার নেই। আমরা বিশেষ বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে জানাই, কিন্তু এটি নিষ্ক্রিয় করতে যেসব সরঞ্জাম দরকার, তাদের কাছে সেসব নেই।’