সিরিয়ার জনগণ স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের অপসারণের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপন করতে রাস্তায় নেমে এসেছেন। দীর্ঘ প্রায় চৌদ্দ বছরের যুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠে দেশটি যত এগোচ্ছে, ততই যেন পরিস্থিতি আরও ভালো হয়ে ওঠার নতুন আশা দেখছেন নাগরিকেরা।
সোমবার গোটা দেশ জুড়ে শহরে শহরে আতশবাজি আর পতাকার ঝলকানি দেখা গেল। বাশার বিরোধীরা মাত্র এগারো দিনের ঝটিকা অভিযানের পর আসাদ রাজবংশের তিপ্পান্ন বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। যার এক বছর পূর্তি হলো গতকাল। দামেস্কে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা সাবেক শাসনকে উৎখাত করার জন্য সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন।
আল–শারা বললেন, ‘ইতিহাসের এই কেন্দ্রে আপনারা যাঁরা আজ উপস্থিত, তাঁরা সাহস আর বীরত্বের এক নতুন গল্প রচনা করছেন। আজ আমরা স্বৈরাচার আর একনায়কত্বের শৃঙ্খল থেকে সিরিয়াকে মুক্ত করার প্রথম বছর পূর্ণ করলাম, দেশকে আবারও তার মহত্ত্বের জায়গায় ফিরিয়ে এনেছি। মাথা উঁচু করে দাঁড়ান আপনারা। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমরা আমাদের স্বদেশ হারিয়েছিলাম, যখন এই চক্রটি তার সভ্যতা, ইতিহাস আর ঐতিহ্য কেড়ে নিতে চেয়েছিল।’
এর আগে, বার্ষিকী স্মরণে সামরিক পোশাকে আল-শারা উমাইয়া মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের পথে বাধা দিতে পারবে না, সে যত বড় বা ক্ষমতাশালীই হোক না কেন। আমরা সব চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করব, ইনশা আল্লাহ। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—আমরা এমন এক শক্তিশালী সিরিয়া আবার গড়ে তুলব যা তার বর্তমান আর অতীতের যোগ্য। এমন এক সিরিয়া যা নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াবে এবং মানুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে।’
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে দামেস্ক এবং হামা, হোমস ও দেইর আজ–জোরসহ বিভিন্ন প্রদেশে সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে, বাশার আল–আসাদের পতনের পর নতুন সরকার নাগরিকদের জন্য মৌলিক পরিষেবা প্রদানে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। গত জুনে এক প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম মাসিক বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে। যার ফলে গত পনেরো বছরে প্রথমবারের মতো আলেপ্পো, হোমস এবং দামেস্কের মতো প্রধান শহরগুলো পরীক্ষামূলকভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে শুরু করেছে।
সিরিয়ার জনগণের মনে অন্ধকার স্মৃতি রেখে যাওয়া সেদনায়া, মেজেহ সামরিক কারাগার, এবং খাতিবের মতো জেলখানাগুলোকেও পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে আল-জাজিরার প্রতিনিধি আসসেদ বেইগ আলেপ্পো থেকে জানালেন, গোটা জাতি আনন্দের মেজাজে রয়েছে, মানুষজন রাস্তায় নেমে উল্লাস করছে, গান গাইছে, পতাকা ওড়াচ্ছে, তবুও ‘অনেক কাজ বাকি।’
তিনি জানান, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিরোধী যোদ্ধা আর আসাদসমর্থক বাহিনীর মধ্যে ভাগ হয়ে থাকা আলেপ্পো শহরটি ‘ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে’ এবং ‘পুনর্গঠন ও মেরামতের জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ হবে।’ বেইগ বলেন, ‘সে কারণেই সরকার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের দিকে বিনিয়োগের আশায় তাকিয়ে আছে, এই দেশকে, বিশেষ করে আলেপ্পোকে পুনর্গঠনে সাহায্য করার জন্য। কারণ এখানে লড়াই ছিল খুবই ভয়ংকর।’
এদিকে, লাখ লাখ শরণার্থী এবং প্রবাসী এক বছর আগে রাশিয়া পালিয়ে যাওয়া আসাদের পতনের পর দেশে ফিরে জীবন নতুন করে গোড়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে দোটানায় আছেন। ২০১১ সালের মার্চে আসাদের বিরুদ্ধে প্রধানত নিরস্ত্র অভ্যুত্থান হিসেবে শুরু হওয়া যুদ্ধ দ্রুতই এক পূর্ণাঙ্গ সংঘাতে রূপ নেয়, যাতে প্রাণ হারান কয়েক লাখ মানুষ। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অভিবাসন সংকটেরও জন্ম দেয়; যুদ্ধের চরম সময়ে, ২০২১ সালে, জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ প্রায় আটষট্টি লাখ সিরিয়ান দেশ ছেড়ে যে যেখানে পেরেছেন আশ্রয় খুঁজেছিলেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সাত লাখ বিরাশি হাজারেরও বেশি সিরিয়ার অন্য দেশ থেকে ফিরেছেন। ফিরে আসার সংখ্যা বাড়লেও, সীমিত চাকরির সুযোগ আর জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনে বাধা দিচ্ছে। অনেকের জন্য আবাসন এখনো ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, ফলে ফিরে আসা মানুষজন ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি কিংবা দামি ভাড়া বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।
সিরিয়ার তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তনের ব্যাপারে বিশেষভাবে আশাবাদী, তবে আরও বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং অর্থনীতিকে চাঙা করে তোলার প্রয়োজনীয়তা জরুরি। মাহা খলিল নামে এক তরুণী শিক্ষার্থী আল-জাজিরাকে বলেন, ‘স্বপ্নের কেবল কিছুটা সত্যি হয়েছে। আমরা বিজয়ী হয়েছি, কিন্তু বছর, বাড়িঘর, আর সন্তানদের হারিয়েছি। আসল গল্পটা এখন শুরু। আমরা আশা করি পুনর্গঠন করতে পারব, কিন্তু যুবকেরা বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবছে। আর যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁরা ফিরে আসতে ভয় পাচ্ছেন।’
বাশার আল–আসাদের পতনের বার্ষিকী উপলক্ষে সিরিয়া আন্তর্জাতিক সমর্থনও পেয়েছে। জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস সিরিয়ার রাজনৈতিক উত্তরণ নিশ্চিত করার জন্য সংস্থার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই বার্ষিকীতে, আমরা এক লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যবদ্ধ—শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি তৈরি করা এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, ঐক্যবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সিরিয়ার প্রতি আমাদের অঙ্গীকার নতুন করে জানানো।’
থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন প্রকল্পের পরিচালক হেইকো উইমেন আল-জাজিরাকে বললেন, আল-শারার আন্তর্জাতিক বৈধতা পাওয়াটা ‘এক অভাবনীয় সাফল্য’ হলেও, সরকারকে এবার দেশের অভ্যন্তরের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। উইমেন বললেন, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর সরকারের উচিত হবে প্রধানত অর্থনীতি পুনর্গঠনের দিকে নজর দেওয়া, ‘যেটাতে সময় লাগবেই, কারণ মূলধন ও বিনিয়োগ সতর্ক থাকে, যা হওয়া উচিত।’ তিনি আরও যোগ করেন, সরকারের উচিত ‘রাজনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্যকে পুনরুজ্জীবিত করা।’
বহু বছর ধরে সিরিয়ার নেতারা ক্ষমতা ‘একচেটিয়াভাবে’ নিজেদের হাতে রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু এখন যেহেতু তাঁরা সমস্ত নাগরিককে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন, তাই এই পদ্ধতি আর চলবে না। উইমেন বললেন, ‘সিরিয়ার প্রত্যেক মানুষকে নিশ্চিত হতে হবে যে, যে দেশটি গড়া হচ্ছে, সেখানে তাদেরও মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে—এবং তাদেরও একটা জায়গা থাকবে।’