ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজা থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া এক সংগঠনের বন্দোবস্তে দক্ষিণ আফ্রিকাগামী ফ্লাইটের প্রতিটি আসনের জন্য ২ হাজার ডলার করে গুনতে হয়েছে ১৩০ গাজাবাসীকে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে গাজার দুজন বাসিন্দা বলেছেন, তাঁরা ওই ১৩০ ফিলিস্তিনির মধ্যে ছিলেন, যাঁদের গত সপ্তাহে গাজা থেকে বাসে করে ইসরায়েলি এক বিমানবন্দরে নেওয়া হয় এবং সেখান থেকে ফ্লাইটে চড়ে গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে পৌঁছান তাঁরা।
এদিকে এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার ‘বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ’ বলে মনে করছে দক্ষিণ আফ্রিকা।
গতকাল সোমবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা বলেন, বিমানের আগমনের যে ‘সন্দেহজনক পরিস্থিতি’ দেখা গেছে, তা তদন্ত করছে দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃপক্ষ।
লামোলা সরকার দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং গাজা যুদ্ধ ইস্যুতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলে আসছে।
গতকাল প্রেস ব্রিফিংয়ে লামোলা বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে সরিয়ে দেওয়ার আরও বৃহত্তর কোনো অ্যাজেন্ডার অংশ এটা।’
গাজায় গণহত্যার অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল। দেশটির দাবি, তাদের সামরিক অভিযান হামাসকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছে; গাজার সাধারণ মানুষকে নয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী লামোলার মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসরায়েলি সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, যদি ফিলিস্তিনিরা গাজা ছাড়তে চান, তাঁদের যেতে দেওয়া উচিত। আর তাঁরা যদি গাজায় ফিরতে চান, তা-ও তাঁদের ফিরে আসতে দেওয়া উচিত।
তবে ওই মুখপাত্র ব্যাখ্যা করেননি—কীভাবে ওই ১৩০ জন গাজাবাসী দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছালেন।
গাজার বেসামরিক বিষয় তদারকি করা ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর শাখা কোগাট জানিয়েছে, গাজাবাসী একটি তৃতীয় দেশের কাছ থেকে তাঁদের গ্রহণের অনুমোদন পাওয়ার পরে চলে যান। তাঁরা সে দেশের নাম জানাননি এবং বলেছেন, তাঁদের বৈধ ভিসা ছিল।
কোগাটের দাবি, গাজাবাসীর প্রস্থানের অনুরোধের সঙ্গে ‘দক্ষিণ আফ্রিকায় অবতরণের অনুমোদনের নথি’ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অন্যদিকে লামোলা বলছেন, ‘আমাদের প্রাথমিক তথ্যমতে, তাদের (দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়া) কাছে প্রয়োজনীয় সেই অনুমোদন ও পারমিট ছিল না।’
বিষয়টি তদন্তাধীন বলেও জানান দক্ষিণ আফ্রিকার এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গত মে মাসে রয়টার্স জানায়, গাজা ছাড়ার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেছে ইসরায়েল এবং প্রায় এক হাজার ফিলিস্তিনিকে ইউরোপসহ বিভিন্ন গন্তব্যের ফ্লাইট ধরার জন্য গাজা থেকে বাসে বের করে নেওয়া হয়েছে।
ওই দুই ফিলিস্তিনি জানান, তাঁরা ‘আল-মাজদ ইউরোপ’ নামের একটি সংগঠনের অনলাইন বিজ্ঞাপন দেখেছিলেন; যেখানে গাজা ছাড়ার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়। তাঁরা ছয় মাস আগে সেখানে আবেদন করেন। প্রস্তাবটি শুধু পরিবারের জন্য ছিল এবং আবেদন করতে পাসপোর্ট থাকা বাধ্যতামূলক ছিল।
আল-মাজদ ইউরোপ হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার মাধ্যমে ওই দুই ফিলিস্তিনিকে জানায়, তাঁদের নিরাপত্তা ছাড়পত্র মঞ্জুর হয়েছে। এরপর তাঁরা বাসে গাজা ছাড়েন এবং ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত কেরেম শালোম সীমান্তপথ দিয়ে পার হন। পরে রামন বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটে তাঁরা রওনা হন এবং ১৩ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান।
৪২ বছর বয়সী রামজি আবু ইউসুফ বলেন, ‘আমি লিম্ফোমা ক্যানসারের রোগী। চিকিৎসার জন্য আমাকে দেশের বাইরে যেতে আর কত দিন অপেক্ষা করা লাগত? তা ছাড়া আমার পরিবারের ভালোর জন্য আমাকে দেশ ছাড়তেই হতো।’
জোহানেসবার্গ থেকে ফোনে রয়টার্সকে এসব কথা বলেন তিনি।
আবু ইউসুফ তাঁর স্ত্রী এবং ৮, ১০ ও ১২ বছর বয়সী তিন সন্তানকে নিয়ে গাজা ছাড়েন। তিনি জানান, ২০২৪ সালের জুনে ইসরায়েলি বাহিনীর নুসেইরাত ক্যাম্পে অভিযানের সময় তাঁর দুই মেয়ে মারা যায় এবং সে সময় তাঁর বাড়িটিও ধ্বংস হয়ে যায়।
রয়টার্স আল-মাজদ ইউরোপের ওয়েবসাইটে দেওয়া একটি ই-মেইল ঠিকানায় বার্তা পাঠায়; তবে কোনো সাড়া মেলেনি। যোগাযোগের জন্য কোনো ফোন নম্বরও ছিল না সংগঠনটির ওয়েবসাইটে।