ভোটকুশলী হিসেবে ভারতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত যিনি, তিনিই প্রশান্ত কিশোর। বলা হয়ে থাকে, তাঁর পরামর্শ ও নকশা অনুসরণ করেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বাজিমাত করেছিল মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস। শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, ভারতের আরও অনেক রাজ্যেই মুখ্যমন্ত্রী বানানোর কারিগর নাকি তিনি। এমনকি ভারতের লোকসভা নির্বাচনেও তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিল দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপি!
সর্বশেষ বিহারের নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজের একটি দলও গড়েন প্রশান্ত। ‘জন-সুরাজ’ নামের সেই পার্টি বিহারে সরকার গঠন করবে এমন ঘোষণাও দেন তিনি। তবে নির্বাচনের আগে আগে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন—তাঁর দল হয় ফার্স্ট হবে, নয়তো লাস্ট। এ অবস্থায় সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে জন-সুরাজ পার্টি কী ফল করে, তা দেখার অপেক্ষায় ছিলেন অনেকেই।
বুথফেরত জরিপের বরাতে শুক্রবার ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, প্রশান্ত কিশোরের জন-সুরজ অভিষেকেই ব্যর্থ। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীও যেন ফলে গেছে—জন-সুরজ পার্টি ফার্স্ট হতে পারেনি, একেবারে লাস্ট হয়ে গেছে।
বিহারের ২৪৩টি আসনের মধ্যে ২৩৮ টিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে প্রশান্ত কিশোর তথা পিকে-এর জন সুরজ পার্টি। যদিও বুথফেরত জরিপগুলো জন সুরজকে আগেই নাকচ করে দিয়েছিল। এনডিটিভির একটি জরিপে পিকের দল মাত্র একটি আসন পেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। শুক্রবার রাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেখা গেছে, এই দল একটি আসনেও জয়লাভ করেনি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিগত সমীকরণ থেকে প্রার্থী বাছাই, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই প্রশান্ত কিশোর মারাত্মক ভুল করেছেন। প্রথমবারের মতো বড় রাজনৈতিক পরীক্ষায় নামা প্রশান্ত কিশোরের কৌশল মাঠে নেমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই নির্বাচনে জন সুরাজ পার্টিকে অনেকেই তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেখছিলেন। কারণ শুরুতে পিকে যেসব ইস্যু সামনে এনেছিলেন, তা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবন–যাত্রার সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুল ছিল পুরো প্রচার-ব্যবস্থা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর তরুণদের ওপর নির্ভর করে চালানো হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা জানিয়েছেন, দলটি অসংখ্য বুথে একজন প্রতিনিধি রাখারও মানুষ পায়নি। আর শুরু থেকেই কিশোরের দলকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলা হচ্ছিল। এ অবস্থায় বিজেপির জোটসঙ্গী নিতীশ কুমার ও তাঁর দল জেডিইউকে নানাভাবে আক্রমণ করে নিজের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু ফলাফল হয়েছে উল্টো।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলও জন সুরাজ পার্টিকে দুর্বল করেছে। দলের ভেতরে বারবার মতবিরোধ সৃষ্টি হওয়ায় কর্মীদের মনোবল তলানিতে নেমে যায়। কিশোরের ব্যক্তিগত আচরণের কারণেও অনেক নেতা তাঁর সঙ্গে স্বচ্ছন্দ বোধ করেননি। আসল কথা হলো—জাতিগত সমীকরণকে সঠিকভাবে ধরতে ব্যর্থতা, শুধু সোশ্যাল মিডিয়া ও ইনফ্লুয়েন্সারের ওপর ভরসা করে নির্বাচন পরিচালনা, নিজে নির্বাচনে না লড়ায় নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হওয়া, বুথ পর্যায়ে দলীয় প্রতিনিধি না থাকা এবং প্রার্থী নির্বাচনে অস্বচ্ছতা ও অসন্তোষ তৈরি হওয়া প্রশান্ত কিশোরকে রাজনীতির ময়দানে নামার আগেই প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দিয়েছে।
তবে শুক্রবার সকালে ভোট গণনার ফল বলছিল, পুরোপুরি ব্যর্থ নন প্রশান্ত কিশোর। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ফলাফল যেমনই হোক প্রশান্ত কিশোরের অনিবার্য ভূমিকা থাকবে এই নির্বাচনে। এ ক্ষেত্রে দেখার বিষয় হলো—কত শতাংশ ভোট পেল তাঁর দল এবং কাদের ঘরে সিঁধ কাটল। বিশেষ করে, দলটি যদি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ভোটে থাবা বসায়, তবে তা নতুন মূল্যায়নের পথ খুলে দেবে।