২০০৬ সাল। দিল্লির অদূরে নয়ডার এক বাংলোর পাশের নর্দমায় পাওয়া গেল হাড় ও দেহাংশ। এরপর আরও তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার হলো প্রায় ১৯ জন নারী-শিশুর কঙ্কাল ও দেহাংশ। আটক করা হয় ওই বাংলোর মালিক ও গৃহকর্মীকে। প্রকাশ্যে আসে প্রায় দুই বছর ধরে নিঠারি বস্তি থেকে একের পর এক শিশু ও নারী নিখোঁজের তথ্য। এই ঘটনা নাড়িয়ে দেয় পুরো ভারতকে।
বাংলোর মালিক মনিন্দর সিং পান্ধের ও গৃহকর্মী সুরিন্দর কোলির বিরুদ্ধে হত্যা, নরমাংস ভক্ষণ ও মৃতদেহের প্রতি বিকৃত আচরণের অভিযোগ ওঠে। ১৩টি মামলা হয় তাদের বিরুদ্ধে। আদালতে নিজেদের দোষ স্বীকারও করেন তারা। কারাগারে ঠাঁই হয় তাদের। দুইজনকেই ধর্ষণ ও হত্যার দণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় বছরের পর বছর কাটতে থাকে তাদের।
এর প্রায় ২০ বছর পর আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে ‘নিঠারি হত্যাকাণ্ড’।
২০০৬ সালে ডিসেম্বরে হওয়া ওই মামলায় তথ্যপ্রমাণের অপর্যাপ্ততা উল্লেখ করে মালিক মনিন্দরকে ২০২৩ সালে খালাস করা হয়। এবার একই কারণ দেখিয়ে গত ১২ নভেম্বর বেকসুর খালাস দেওয়া হলো গৃহকর্মী সুরিন্দরকে। আদালতে সুরিন্দর দাবি করেন, নির্যাতন করে তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। এই দাবিকে গ্রাহ্য করে এবং তথ্য প্রমাণ না পাওয়ায় খালাস পান তিনি।
এই বেকসুর খালাস পাওয়ার খবরে নিঠারিবাসীর মনে এখন একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘যদি মনিন্দর আর সুরিন্দর দোষী না-ই হয়, তাহলে আমাদের সন্তানদের হত্যা করল কে?’
নিঠারির বাসিন্দারা সমাজের হতদরিদ্র বা দিনমজুর সমাজের মানুষ। এই বিভীষিকা ভুলতে নিঠারি বস্তি ছেড়ে অনত্র চলে গিয়েছেন অনেকে। এই রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলার মতো বা মামলায় লড়াই করার মতোও তাদের এখন আর সামর্থ্যে কুলাচ্ছে না।
২০০৫ সালের গ্রীষ্মে নিখোঁজ হয় নিঠারির বাসিন্দা ১০ বছর বয়সী জ্যোতি। নয়ডার ওই বাংলোর পাশে পাওয়া কঙ্কাল ও দেহাংশর ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হয় জ্যোতিও এই হত্যাকাণ্ডের শিকার। রায় শুনে তার মা সুনীতা কানৌজিয়া অশ্রুসজল চোখে প্রশ্ন করেন, ‘তারা যদি নির্দোষই হয়ে থাকে, তাহলে কেন ১৮ বছর জেলে থাকতে হলো? তিনি বলতে থাকেন, ‘যারা আমার জ্যোতিকে হত্যা করেছে, ঈশ্বর তাদের ক্ষমা করবেন না।’
জ্যোতির বাবা ঝাব্বু লাল কানৌজিয়া এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে শুরু থেকে সাহায্য করেছিলেন। সুরিন্দরের খালাসের খবর শুনে হতাশায় ভেঙে পড়েন তিনি। এত বছর ধরে মামলার জন্য সংগ্রহ করা সব তথ্যপ্রমাণ জ্বালিয়ে দেন।
মেয়ের নিখোঁজের পর ১৫ মাস ধরে নিয়মিত থানায় ধরনা দিয়েছেন ঝাব্বু লাল। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ সংগ্রহ করতে বছরের পর বছর মনিন্দরের বাংলোর পাশে কাপড় ইস্ত্রি করার কাজ করেছেন তিনি।
ঝাব্বু লাল বলেন, ‘কেউ হারিয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না। এটা সারাজীবনের ক্ষত হয়ে থেকে যায়। আর যন্ত্রণা দিয়ে যায়। সবসময় মাথায় ঘুরতে থাকে, তারা কোথায় আছে, কেমন আছে?’
তাঁর মনে এখন বারবার এই প্রশ্নই আসে, ‘যদি তারা দোষী না হয়, তাহলে দোষী কে? আর আমাদের সন্তানদের ভাগ্যে তখন কি ঘটেছিল?’
দোষী সাব্যস্ত দুজনেরই এমনভাবে মুক্তি মানসিক শান্তি কেড়ে নিয়েছে জ্যোতির বাবা ঝাব্বু লালের। পুরনো ক্ষতগুলো আবারও যেন রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আর কোনো লড়াই বাকি আছে কি না জানি না। আমি এক বৃদ্ধ মানুষ। ভেঙে পড়েছি আমি।’
সুরিন্দরকে খালাসের আদেশে সুপ্রিম কোর্ট বলেন, ‘নিঠারিতে সংঘটিত অপরাধগুলো ছিল নৃশংস। পরিবারগুলোর যন্ত্রণার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না।’
২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলোর মালিক মনিন্দর সিং পান্ধের বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। অন্যদিকে গৃহকর্মী সুরিন্দর কোলি কারাগার থেকে বের হওয়ার পর থেকে একবারও প্রকাশ্যে আসেননি। এ নিয়ে কোনো মন্তব্যও করেননি।
সুরিন্দরের খালাসের রায় দেওয়ার সময় বিচারকেরা বলেন, তার স্বীকারোক্তি থেকে ‘মনে হচ্ছিল, তাকে টিউটর করা হচ্ছে।’ হেফাজতে রাখার ৬০ দিন পর এই জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল।
তার বিরুদ্ধে উপস্থাপিত সব প্রমাণই ছিল সাজানো বলে দাবি করেন তার আইনজীবী যুগ মোহিত চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘১৯ বছর পার হয়েছে। যে ১৩টি মামলায় সুরিন্দরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ১২টিতেই তিনি ইতিমধ্যে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। একটি মামলা বাকি ছিল, যাতে পাঁচটি আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।’
সুরিন্দরের আইনজীবী পিটিআইকে বলেন, ‘আজ সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলায় আগের চার-পাঁচটি রায়ও বাতিল করে দিয়েছে। অভিযোগগুলো ছিল অত্যন্ত গুরুতর, কিন্তু সব প্রমাণই সাজানো ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে রক্ষা করার জন্য এই অসহায় মানুষটিকে ফাঁসানো হয়েছিল। প্রতিটি প্রমাণ ছিল জাল। একটি প্রমাণও এমন ছিল না যা দিয়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যেত।’
যুগ মোহিত চৌধুরী আরও বলেন, ‘আপনাদের এ প্রশ্ন সিবিআইকে (ফেডারেল সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) করা উচিত। কারণ এটা স্পষ্ট, সিবিআই আসল অপরাধী কে সেটা জানার পরও নির্দোষ মানুষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রমাণ তৈরি করে ফাঁসিয়েছে। সিবিআইকে এই প্রশ্নগুলো করুন।’
আদেশে তদন্তকারীরা তদন্তের নির্দেশনা অনুসরণ করেননি উল্লেখ করে আদালতও পুলিশ এবং তদন্ত সংস্থাগুলোকে সমালোচনা করেন। আদেশে বলা হয়, তদন্তকারীরা ‘সহজ পথ বেছে নিয়ে বাড়ির দরিদ্র গৃহকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন এবং তাকে ভয়ংকর রূপে উপস্থাপন করেছেন।’
জ্যোতির বাবা ঝাব্বু লাল বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত এমন পুলিশকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হবে না, ততক্ষণ আমরা ন্যায়ের সন্ধান পাব না।’
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের কাছে নিঠারির নিখোঁজ শিশু বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকেরা যতবারই গিয়েছিলেন, তারা একই উত্তর দিয়েছেন যে তাদের মেয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে।
নিঠারির বাসিন্দা পাপ্পু লালের মেয়ে রচনা ২০০৬ সালের ১০ এপ্রিল দাদা-দাদীকে দেখতে যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়। পাপ্পু লাল জানান, মনিন্দরের বাংলোর দুই বাড়ি পরে থাকতেন রচনার দাদা-দাদি। ৮ বছরের ওই শিশুটির খোঁজ না পেয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দিতে গেলে পুলিশ বলে, তাদের মেয়ে হয়তো প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়েছে।
রচনার খোঁজে অন্যান্য শহর ও রাজ্যে গিয়েছেন পাপ্পু লাল। এর তাঁর এই খোঁজের অবসান ঘটে আট মাস পর, মনিন্দরের বাংলোর পেছনের গলি থেকে রচনার কাপড় ও জুতো উদ্ধারের মাধ্যমে।
পাপ্পু লাল বলেন, ‘যদি পুলিশ সময়মতো পদক্ষেপ নিত, রচনাকে বাঁচানো যেত। আরও অনেক শিশুকেও বাঁচানো যেত।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এখনো সেই দিনগুলো ভুলতে পারছি না। আমি পুলিশে গিয়ে নতুন অভিযোগ করব। তাদের খুঁজে বের করতে হবে, আমাদের সন্তানদের কে হত্যা করেছে।’
ন্যায়বিচারের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে দেখা করতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের লড়াই এখন সরকারের সঙ্গে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদেরও আছে। আমাদের সন্তানরা কি ভারতের সন্তান নয়?’
তবে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সহায়তা করে আসা বেটার ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন চ্যারিটির অনুপম নাগোলিয়া মনে করছেন, এখন আর এই পরিবারগুলোর লড়াইয়ের পথ নেই। তিনি বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বেঞ্চ থেকে রায়টি এসেছে। এখন তাদের আপিল করার মতো আর কোনো জায়গা আমি দেখি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর হারানোর সদস্যদের কথা মনে করে কাঁদা ও শোক পালন করা আর কিছুই করার নেই।’
তবে কিছু আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবারগুলোর সামনে এখনো একটি শেষ বিকল্প আছে। তারা সুপ্রিম কোর্টে পুনরায় তদন্তের নির্দেশনার জন্য আবেদন করতে পারে।
অবসরপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি মদন লোকুর বলেন, ‘এই পথেও ফল পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ এতটা দিন পেরিয়ে গেছে। প্রমাণগুলো নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছে। আর পুনরায় তদন্তের সম্ভাবনাও কার্যত অসম্ভব।’
আর নয়ডার ওই বাংলো এখন যেন পরিণত হয়েছে ‘হরর হাউস’-এ। ইট ও কাদামাটি দিয়ে দেয়াল তৈরি করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে প্রবেশদ্বার। বোগেনভেলিয়া গাছের জঙ্গলে ছেয়ে গেছে স্যাঁতসেঁতে দেয়ালগুলো। গোলাপি বোগেনভেলিয়ায় সেজে থাকা পরিত্যক্ত বাংলোর পাশের সেই নর্দমায় এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগ-বোতল-কাদা আর বাতাসে তীব্র দুর্গন্ধ।
২০০৬ সালে ডিসেম্বরের তীব্র শীতের দিনে এই নর্দমায় আরও অনেকের সঙ্গে কঙ্কাল, হাড় ও দেহাংশ উদ্ধারের জন্য নেমেছিলেন জ্যোতির বাবা ঝাব্বুলাল। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, উদ্ধারকৃত খুলি ছিল ১৯টির চেয়েও অনেক বেশি।
সূত্র: বিবিসি