বিশ্বের অন্যতম সেরা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র, যা ভারতে ‘সুদর্শন চক্র’ নামে পরিচিত। সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নিজের কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রমালিকানাধীন অস্ত্র কোম্পানি আলমাজ-আন্তের তৈরি এই উন্নত দীর্ঘ পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র (এসএএম) ব্যবস্থাটি ২০১৮ সালে ভারতের সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হয়। এরপর থেকে ভারতের সামরিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে বলে মনে করেন সামরিক বিশ্লেষকেরা।
২০২৫ সালের মে মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সময় ভারত এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করে। বিভিন্ন ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উত্তর ও পশ্চিম ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে আসা একাধিক পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা প্রতিহত ও অকার্যকর করে দেয়। এর মধ্যে জম্মু, পাঠানকোটে এবং অমৃতসরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো হামলাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সম্ভাব্য বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধানের মতে, এস-৪০০ ছিল একটি ‘গেম চেঞ্জার’, যা পাকিস্তানি বিমানগুলোকে ৩১৪ কিলোমিটার দূরের রেকর্ড দূরত্বে ভূপাতিত করে। যদিও পাকিস্তান এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও বৈশিষ্ট্য
এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যা ন্যাটোর পরিভাষায় ‘এসএ-২১ গ্রোলার’ নামে পরিচিত। এটি ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে রাশিয়ার আলমাজ-আন্তে সেন্ট্রাল ডিজাইন ব্যুরো দ্বারা উন্নত করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল আমেরিকান এমআইএম-১০৪ (MIM-104) প্যাট্রিয়টের মতো পশ্চিমা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মোকাবিলা করা এবং পুরোনো এস-২০০ ও এস-৩০০ ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন করা। এটি যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্রুজ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি শনাক্ত, ট্র্যাক ও ধ্বংস করতে সক্ষম। এর রাডার ৬০০ কিলোমিটার দূর থেকে ৩০০টি লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ট্র্যাক করতে পারে। এটি ১৪ মাক গতিতে অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে ১৪ গুণ বেশি গতিতে আঘাত হানতে পারে এবং ৩০ কিলোমিটার উচ্চতায় লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম। এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মাত্র ৫-১০ মিনিটের মধ্যে মোতায়েন করা যায় এবং এটি অত্যন্ত সহজে স্থানান্তরযোগ্য, যা এটিকে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার করে তুলেছে।
কতগুলো এস-৪০০ এখন ভারতের হাতে
২০১৮ সালে ভারত ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তিতে রাশিয়ার কাছ থেকে পাঁচটি এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তিনটি ইউনিট ভারত হাতে পেয়েছে। বাকি দুটি সিস্টেম আগামী বছরের শেষ নাগাদ সরবরাহ করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল বিবেক রাম চৌধুরী।
কোথায় মোতায়েন হয়েছে এস-৪০০
ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির সেনাবাহিনী হুমকি বিশ্লেষণ করে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এই সিস্টেম মোতায়েন করেছে। প্রথম ইউনিটটি মোতায়েন করা হয়েছে পাকিস্তান সীমান্তঘেঁষা পাঞ্জাবে। দ্বিতীয় ইউনিটটি মোতায়েন করা হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্যে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি অরুণাচল প্রদেশে, যার সঙ্গে চীনের দীর্ঘকালীন সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। তৃতীয় ইউনিটটি মোতায়েন হয়েছে পশ্চিম ভারতের মরুরাজ্য রাজস্থানে, যা পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে।
কেন এটিকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলা হচ্ছে
ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাবেক উপপ্রধান কাপিল কাক স্পুটনিক ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এস-৪০০ একসঙ্গে প্রায় ৬০টি শত্রুপক্ষের টার্গেটকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে। আগে যেখানে এক বা দুটি লক্ষ্যবস্তু মোকাবিলা করা যেত, এখন সেই ক্ষমতা ৩০ গুণ বেড়েছে। এটিই একে প্রকৃত অর্থে গেম চেঞ্জার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ভেঙ্কটেশ বলাসুব্রামানিয়মের মতে, এস-৪০০ একসঙ্গে নানা ধরনের হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। যেমন ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান ও যুদ্ধবিমান। এর মোতায়েনের সময় প্রায় পাঁচ মিনিট, অর্থাৎ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দ্রুত স্থান পরিবর্তন করে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা সম্ভব।
ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের (আইএএফ) সাবেক কর্মকর্তাদের ভাষায়, এস-৪০০ কেবল একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নয়, বরং এটি ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত পাকিস্তান ও চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলায় শক্তিশালী ঢাল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।