বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চল সোমালিল্যান্ডকে একটি ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আবদিরহমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহি (সিরো) এক ভার্চুয়াল বৈঠকে এ-সংক্রান্ত একটি যৌথ ঘোষণাপত্রে সই করেন।
তবে ইসরায়েলের এই পদক্ষেপকে ‘রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন’ হিসেবে অভিহিত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সোমালিয়া সরকার। মোগাদিশুর দাবি, এটি সোমালিয়ার সার্বভৌমত্বের ওপর নগ্ন হামলা এবং এর পেছনে ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করে সোমালিল্যান্ডে পাঠানোর গোপন পরিকল্পনা রয়েছে। সেই সঙ্গে তারা সোমালিল্যান্ডকে দেওয়া ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই ঐতিহাসিক মাইলফলককে ‘আব্রাহাম চুক্তি’র অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এর মাধ্যমে দুই দেশ পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে একে অপরের রাজধানীতে দূতাবাস ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইসরায়েল সোমালিল্যান্ডকে সরাসরি সহায়তা দেবে।
সোমালিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলি ওমর আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসরায়েলের এই ধৃষ্টতা কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। এটি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন।
সোমালিয়ার অভিযোগ, ইসরায়েল গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে সোমালিল্যান্ডে পুনর্বাসিত করার জন্য এই স্বীকৃতির চাল চেলেছে। ফিলিস্তিন সরকারও এই আশঙ্কায় সংহতি প্রকাশ করে একে একটি ‘বিপজ্জনক সীমা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
সোমালিয়া সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সোমালিল্যান্ড তাদের ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এর অখণ্ডতা রক্ষায় তারা যেকোনো কূটনৈতিক ও আইনি পদক্ষেপ নেবে।
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে বিশ্ব রাজনীতিতেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়া সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ইস্যুতে নেতানিয়াহু থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। তিনি নিউইয়র্ক পোস্টকে বলেছেন, ‘আমি এখনই এই পথে হাঁটব না।’
এদিকে আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহামুদ আলি ইউসুফ সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার যেকোনো উদ্যোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, এতে বিপজ্জনক নজির তৈরি হবে, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে পারে। আফ্রিকান ইউনিয়ন ১৯৬৪ সালের একটি নীতির কথা উল্লেখ করে, যেখানে স্বাধীনতার সময় উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সীমান্ত অক্ষুণ্ন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
আরব লিগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইতও ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি একে একটি আরব ও আফ্রিকান রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর উসকানিমূলক আক্রমণ বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মধ্যেও শুক্রবার হারগেইসার রাস্তায় হাজারো মানুষ নেমে আসে উদ্যাপনে। অনেকের কাছে এটি ছিল ৩০ বছরের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান। দেশটির জাতীয় জাদুঘরে ইসরায়েলের পতাকা টানানো হয় এবং বাসিন্দারা এই স্বীকৃতিকে স্বাগত জানান।
ঐতিহাসিকভাবে সোমালিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্কে টানাপোড়েন আছে। এর পেছনে রয়েছে সোমালিয়ার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইথিওপিয়ার সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ইসরায়েল ইথিওপিয়াকে সামরিক প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা সহায়তা ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। অন্যদিকে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ সোমালিয়া ১৯৭৭ সালের ওগাডেন যুদ্ধে পরাজিত হয়, যা পরবর্তী কয়েক দশকের গৃহবিবাদকে উসকে দেয়।
১৯৯১ সালে তৎকালীন নেতা মোহাম্মদ সিয়াদ বারের শাসনামলে নিপীড়নের পর সোমালিল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও সোমালিয়া কখনোই অঞ্চলটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘের কোনো সদস্যরাষ্ট্রও অঞ্চলটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে সোমালিল্যান্ড নিজেদের আলাদা মুদ্রা, পতাকা ও সংসদ গঠন করেছে।
হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে বাবেল মান্দেব প্রণালির কাছে কৌশলগত অবস্থানের কারণে এই অঞ্চল ভূরাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলতি মাসের শুরুতে ইসরায়েলের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল জানান, হুথির প্রভাব নিয়ে যৌথ উদ্বেগের বিষয়ে সোমালিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। তবে সোমালিয়ার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আলি ওমর এই দাবি অস্বীকার করে বলেন, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং ইসরায়েলি নীতির বিষয়ে সোমালিয়ার অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।