পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। প্রতিবছরের মতো এবারও শিশুদের আক্রান্তের হার এবং জটিলতা বেশি। জিনগত পরিবর্তনের ফলে এডিস মশা এখন রাতেও কামড়ায় এবং ময়লা পানিতে বংশবিস্তার করছে। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীদের রক্তে ভাইরাসটির নতুন নতুন সেরোটাইপ শনাক্ত হচ্ছে। এবার সেরোটাইপ ১-এর আধিক্য বেশি।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও পরীক্ষা
- ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা যায়। ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার তীব্র জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের চারপাশে কিংবা পুরো শরীরে ব্যথা থাকে। সেই সঙ্গে অনেকের থাকে বমি কিংবা বমিভাব ও র্যাশ। তবে ডেঙ্গুর উপসর্গের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক শিশুর জ্বরের সঙ্গে থাকছে পাতলা পায়খানা এবং অনেকের জ্বরের মাত্রা তীব্র হচ্ছে না।
- এ সময় জ্বর হলে প্রথম তিন দিনের মধ্যে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গুর পরীক্ষা বা ডেঙ্গু এনএসআই অ্যান্টিজেন করাতে হবে। সঙ্গে যদি চিকিৎসকদের পরামর্শে রক্তের অন্যান্য পরীক্ষা থাকে। রক্তের গ্রুপ করানো না থাকলে চিকিৎসককে বিষয়টি জানাতে হবে।
- অনেক সময় ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ থাকে কিন্তু পরীক্ষায় পজিটিভ আসে না। সে ক্ষেত্রে আবারও পরীক্ষা করাতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে মা-বাবা এবং অভিভাবকদের জন্য জরুরি করণীয় হচ্ছে, জ্বর কখন আসছে সেই সময় থেকে হিসাব করে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
- ডেঙ্গু শনাক্ত হলে প্রায় প্রতিদিন রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন হয় এবং অনেক সময় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা জরুরি হয়ে পড়ে।
ডেঙ্গু রোগীরা পর্যায়ক্রমে তিনটি অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়:
১. ফেব্রাইল ফেজ: প্রথম তিন থেকে চার দিন; তীব্র জ্বর এবং অন্যান্য উপসর্গ থাকে।
২. ক্রিটিক্যাল ফেজ বা এফেব্রাইল ফেজ: এর সময়কাল জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরের ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা। যেসব রোগী মারাত্মক ডেঙ্গুতে ভোগে, এ সময় তাদের রক্তচাপ কমে যাওয়া, ফুসফুস ও পেটে পানি জমা ইত্যাদির মতো উপসর্গ দেখা যায়। তখন হাসপাতালে ভর্তি জরুরি হয়ে পড়ে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এই ক্রিটিক্যাল ফেজটি দীর্ঘায়িত হতে পারে।
৩. কনভালেসেন্ট ফেজ: এর সময়কাল দুই থেকে তিন দিন। এ সময় শিশু ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে, খাবারের রুচি ফেরত আসে। এ সময় আবারও র্যাশ দেখা দিতে পারে, শরীর চুলকাতে পারে এবং শিশু বেশ দুর্বল থাকতে পারে। অনেক সময় হার্টের গতি কমে যায়, অতিরিক্ত প্রস্রাব হয় এবং অতিরিক্ত ঘাম হতে থাকে।
- জ্বর কমানোর জন্য শিশুর ওজন অনুসারে প্যারাসিটামল দিতে হবে। স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে পুরো শরীর বারবার মুছিয়ে দিতে হবে। জ্বর থাকলেও ন্যূনতম চার ঘণ্টার আগে প্যারাসিটামলের পরবর্তী ডোজ দেওয়া যাবে না।
- দ্রুত জ্বর কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যাসপিরিন, ডাইক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেন, ন্যাপরক্সেন, মেফেনেমিক অ্যাসিড, স্টেরয়েড ও অ্যান্টিবায়োটিকজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
- কোনো শিশু যদি অ্যাসপিরিন কিংবা ওয়ারফেরিনজাতীয় ওষুধ নিয়মিত খেয়ে থাকে, তাহলে চিকিৎসককে জানিয়ে তা বন্ধ রাখতে হবে রক্তের অণুচক্রিকা বা প্লাটিলেট স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং শিশু যেন পর্যাপ্ত পরিমাণে তরলজাতীয় খাবার, যেমন পানি, স্যালাইন, ডাবের পানি, স্যুপ, ফলের রস খায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অন্যান্য খাবার খাওয়া নিয়ে এ সময় শিশুকে জোর করবেন না।
- রক্তের অণুচক্রিকা কমা শুরু করলে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজা এবং মলদ্বারে সাপোজিটরি দেওয়া থেকে বিরত থাকা ভালো।
যেসব সমস্যায় শিশুকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, সেগুলো হলো
- অতিরিক্ত ওজন থাকলে।
- আগে ডেঙ্গু হলে।
- বয়স এক বছরের নিচে হলে।
- অ্যাজমা বা হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, কিডনি ও লিভারের সমস্যায় আক্রান্ত থাকলে।
- স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ খেলে।
যেসব লক্ষণে শিশুকে হাসপাতালে নিতে হবে
- অতিরিক্ত পেটব্যথা।
- সারা দিনে তিনবারের বেশি বমি কিংবা তিনবারের বেশি পাতলা পায়খানা।
- অতিরিক্ত অস্থিরতা কিংবা নেতিয়ে যাওয়া।
- হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া কিংবা হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
- বসা থেকে দাঁড়ালে মাথা ঘোরা কিংবা চোখে অন্ধকার দেখা।
- অতিরিক্ত ঘাম।
- শ্বাসকষ্ট।
- ৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া।
- নাক ও মাড়ি থেকে, কাশির সঙ্গে কিংবা প্রস্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্তক্ষরণ হলে।
লেখক: স্পেশালিস্ট, পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা