হোম > স্বাস্থ্য

এনসিডি কর্নার ৮ মাস ধরে স্থবির: সারা দেশে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের রোগীরা ঝুঁকিতে

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা

ডায়াবেটিস বা হৃদ্‌রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমাতে সরকারের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) কর্মসূচি। এর অধীনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের জনসাধারণকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস-বিষয়ক বিভিন্ন জরুরি সেবা দেওয়া হয়। তবে সরকারের ৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা (অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি) কার্যকর না থাকায় আট মাস ধরে এনসিডি কর্নারের কার্যক্রমে স্থবিরতা চলছে। আগামী মাসে ওষুধের বড় ধরনের সংকটের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।

দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং টিকা, পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচি পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা ওপির মাধ্যমে। সর্বশেষ ওপি ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি (এইচপিএনএসপি)’ শেষ হয় গত বছরের জুনে। ওই বছরের জুলাই মাসেই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা অনুমোদন করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে এখন ওপি থেকে বের হওয়ার কথাই ভাবছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। নতুন সেক্টর কর্মসূচি না নিয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রমগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর সময় ধরা হয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত। পরিকল্পনা কমিশনও সেক্টর কর্মসূচির বিকল্প ভাবার পরামর্শ দিয়েছে।

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার স্তরে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মডেল বাস্তবায়ন করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য। ২০১৮ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রথম সিলেটের চারটি উপজেলায় এনসিডি কর্নার চালু করা হয়। এতে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্ত, চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, ওষুধ বিতরণ ও রোগীদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়। রোগীদের নিবন্ধন করে নিয়মিত ফলোআপ করা হয়। দেশের ৪২৯টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১০টি জেলা হাসপাতালে এই কর্নার রয়েছে। এনএইচএফবি, জাইকা, আইসিডিডিআর,বি, ব্র্যাক হেলথসহ আটটি প্রতিষ্ঠান কর্নারগুলো স্থাপনে সরকারকে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি এগুলো স্থাপন এবং যন্ত্রপাতি ও ওষুধের খরচ চালানো হয় ওপির টাকায়। বর্তমানে ওপি না থাকায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত নিবন্ধিত ১০ লাখ রোগী এখন চাহিদামতো ওষুধ পাচ্ছে না। এপ্রিল মাসে সংকট ভয়াবহ পর্যায়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নিবন্ধিত রোগীদের চিকিৎসা, ফলোআপ এবং ওষুধ পাওয়ার জন্য একটি ‘সবুজ বই’ দেওয়া হয়, যা ছাপার কাজ অর্থাভাবে বন্ধ রয়েছে। ইতিমধ্যেই রক্তের শর্করা পরিমাপের গ্লুকোমিটার স্ট্রিপের বেশ অভাব দেখা দিয়েছে।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, এনসিডি কর্নারে মূলত ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য মেটফরমিন ও গ্লিক্লাজাইড, উচ্চ রক্তচাপের জন্য অ্যামলোডিপিন, লোজারটেন পটাশিয়াম, হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড ইত্যাদি ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়া হৃদ্‌রোগীরা পান অ্যাসপিরিন ও রোজুভাসটেটিন। ওষুধগুলো সুলভ ও সহজলভ্য হলেও ওপি বন্ধ থাকায় তা নতুন করে কেনা হচ্ছে না। অথচ কর্নারে প্রতি মাসে নতুন করে ৬ থেকে ৭ হাজার রোগীর নিবন্ধিত হচ্ছে।

ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো স্বাস্থ্যসমস্যার রোগীদের নিয়মিত ওষুধ গ্রহণ ও চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যমতে, এ অসুখ দুটি হৃদ্‌রোগ, কিডনি, স্নায়বিক সমস্যা, ক্যানসারসহ বিভিন্ন অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। আবার ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। ডায়াবেটিসে অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো হৃদ্‌রোগ। এই ঝুঁকি উচ্চ রক্তচাপের কারণে আরও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ স্বাস্থ্য বুলেটিন বলছে, দেশে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে কমলেও বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। রোগে মৃত্যুর ৭০ শতাংশই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে। সব মিলিয়ে মোট মৃত্যুর ৩৪ শতাংশ হৃদ্‌রোগ এবং ৪ শতাংশ ডায়াবেটিসের কারণে হচ্ছে।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি এনসিডি কর্নার। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জামসেদ ফরিদী আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এ কর্নারে এখন পর্যন্ত ওষুধের সংকট দেখা যায়নি। তবে তারা হিসাব করে ওষুধ খরচ করছেন।

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওপি ছাড়া কার্যক্রম কীভাবে চলবে সরকারকে তা ৩১ মার্চের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে অনুযায়ী কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাদের এনসিডি কর্নার চালু রাখার দায়িত্ব দিয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতে পারে। ওপি না থাকলেও কর্নারের কার্যক্রম যাতে চলমান থাকে তা ভাবা হচ্ছে। তবে এতে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা আর থাকবে না।

উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. রাহাত ইকবাল চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, এ বছর থেকে জেলা হাসপাতাল এবং পরবর্তী সময়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও এনসিডি কর্নার চালুর কথা ছিল। এখন ওপি না থাকায় কর্নারগুলো আর হচ্ছে না। বই বিতরণ, যন্ত্রাংশ, ওষুধের সংকট রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যেন এনসিডির কাজ থেমে না যায়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অর্গানোগ্রামে এটি রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এনসিডি কর্নারের গুরুত্ব তুলে ধরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘এনসিডি কর্নারের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষকে হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো গেছে। বিশেষ করে দরিদ্রদের। কর্নারে শুরুতে যাঁরা চিকিৎসার জন্য আসতেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। ওপি না থাকার কারণে এনসিডির কাজ থেমে গেলে তা হবে চরম ব্যর্থতা।’

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘ওপি না থাকলে যেন কোনো কার্যক্রমই বন্ধ না হয় সে বিষয়ে আমরা পরিকল্পনা করছি।’

আরও খবর পড়ুন:

কবিরাজিসহ প্রথাগত চিকিৎসার কার্যকারিতা খতিয়ে দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

শীতে খিচুড়ি কেন খাবেন

এই শীতে কেন খাবেন তেজপাতা ও লবঙ্গ চা

ঘুমের ঘোরে খাওয়া রহস্যময় ও জটিল এক স্বাস্থ্য সমস্যা

যে ছয় কারণে দীর্ঘস্থায়ী শুকনো কাশি হয়

ঠান্ডার সময় ব্যায়াম শুরু করার আগে

ভারতে চিকিৎসকদের জন্য হাতে প্রেসক্রিপশন লেখার নতুন নিয়ম

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি: অর্থায়ন বন্ধে যক্ষ্মা বিস্তারের শঙ্কা

এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৬.৫৭ শতাংশ

শীতে যেসব খাবার মন শান্ত রাখবে