সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের উল্লিখিত ‘শরীফার গল্প’ নিয়ে নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্র হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে ‘শরীফার গল্প’ অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব উৎস। এ ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ঝর্ণার গল্প’ লেখা একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, এটি কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমের বইয়ের পৃষ্ঠা।
‘ওয়েলকাম বাংলাদেশ’ নামে ২৭ হাজার ফলোয়ারের একটি পেজ থেকে ২১ জানুয়ারি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিটি শেয়ার করে লেখা হয়, ‘শরীফার গল্প বা ঝর্ণার গল্পই শুধু নয়। নতুন কারিকুলামের প্রতিটি পাতায় পাতায় রয়েছে ইসলামী বিদ্বেষ; সাথে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর কঠোর আঘাত। আচ্ছা আমি একজন শিক্ষক আমি কীভাবে আমার ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এইভাবে খোলামেলা এইগুলো পড়াতে পারি!! এইখানে উভয় ছাত্র/ছাত্রী উপস্থিত। আর কোন মা বাবা তার ছেলেমেয়েকে কিভাবে এইগুলো পড়াবে। এইগুলো পাঠ্যপুস্তকে সরাসরি না দিলে কি হতো না!!’
লুৎফুর রহমান নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ছবিটি তাঁর অ্যাকাউন্টে শেয়ার করে লিখেছেন, ‘এইগুলো কি আমাদের শেখার দরকার আছে? শিক্ষাকে যৌনতায় নিয়ে যাচ্ছেন কেন? ছেলে মেয়ে উভয় যখন ক্লাসে এইগুলো এক সাথে পড়বে, তখন তাদের মাঝে কি বিরাজ করবে??’ লুৎফুর রহমানের এই পোস্টে একজন জানতে চান, বইয়ের পৃষ্ঠা কোন শ্রেণির? উত্তরে তিনি জানান, নবম শ্রেণির বই। (ফেসবুক পোস্টগুলোর ভাষাগত কোনো পরিবর্তন করা হয়নি)
ভাইরাল বইয়ের পৃষ্ঠাটি কি নতুন পাঠ্যক্রমের বা নবম শ্রেণির? যাচাই করে দেখেছে আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক বিভাগ।
এই সূত্রে পরবর্তী অনুসন্ধানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যের ওয়েবসাইটে ‘আমার জেমস ডায়েরি, জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্প’ নামে একটি বই খুঁজে পাওয়া যায়। বইটির ৫৫ পৃষ্ঠায় ‘ঝর্ণার গল্প’ নামক অংশটি খুঁজে পাওয়া যায়।
‘আমার জেমস ডায়েরি’ বইটির পরিচয়ে লেখা আছে, এটি প্রকাশনার দায়িত্বে ছিল প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সম্পাদনা ও পরিমার্জনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ (এনসিটিবি)। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য বইটির সার্বিক নির্দেশনায় ছিলেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হয়।
প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ‘সেক্স এডুকেশন: সাড়ে তিন শ স্কুলের শিক্ষার্থীরা ‘জেনারেশন ব্রেক থ্রু’র ক্লাসরুমে পাঁচ বছরে যা শিখলো’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের চারটি জেলার ৩৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম চালু করা হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের জেমস বা ‘জেন্ডার ইকুয়িটি মুভমেন্ট ইন স্কুলস’ নামে একটি কোর্স পড়ানো হয়। কোর্সটি সাজানো হয়েছিল ‘আমার জেমস ডায়েরি’ নামের একটি বই, সাতটি কম্পিউটার গেমস, দুটি বোর্ড গেম, একটি অ্যানিমেশন ভিডিও আর এক শ পর্বের রেডিও ধারাবাহিক দিয়ে।
বিবিসির ওই প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, ২০১৮ শেষ হওয়ার সাথে সঙ্গেই জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। যদিও তখন অনেক বিদ্যালয়ে কোর্সটি পড়ানো অব্যাহত ছিল। তবে তখন প্রকল্পটির তৎকালীন পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বিবিসিকে জানান, ‘তারা অচিরেই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করবেন।’ সেখানে বিদ্যমান সাড়ে ৩০০ বিদ্যালয়ের সঙ্গে আরও ২০০টি বিদ্যালয় যুক্ত করা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটির প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে বিস্তারিত তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রথম পর্যায়ের সফলতার ধারাবাহিকতায় আরও পাঁচটি জেলা সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, মৌলভীবাজার, পটুয়াখালী ও রাঙামাটি জেলার ২৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ প্রকল্পের অর্থায়ন করছে কানাডা সরকার। ইউএনএফপিএর কারিগরি সহায়তায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কনসার্নড উইমেন ফর ফ্যামিলি ডেভেলপমেন্ট (সিডব্লিউএফডি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য।
প্রকল্পটি বর্তমান অবস্থা ও প্রকল্পের বইটি এখনো বিতরণ করা হয় কি না, সে সম্পর্কে জানতে দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক বিভাগ। বর্তমানে তিনি মাউশির প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক হিসেবে আছেন। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এই প্রকল্প ২০২১-২২ সালেই শেষ হয়ে গেছে। আমি যদ্দুর জানি, এটা শেষ হয়ে গেছে। এরপর আর এটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।’
মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার উপপরিচালক মো. মুরশীদ আকতারও আজকের পত্রিকা ফ্যাক্টচেক বিভাগকে প্রকল্পটি চালু নেই বলে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটি বছরখানেক হবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে এবং এই প্রকল্প পাইলটিং ছিল, এর অনেক কিছুই বর্তমান পাঠ্যপুস্তকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই প্রকল্পটির কোর্স ম্যাটারিয়ালেরও আর ভ্যালিডিটি নেই।’
পরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইট থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইগুলো খুঁজে ভাইরাল পৃষ্ঠাটির মতো কোনো পৃষ্ঠা বা ‘ঝর্ণার গল্প’ নামে আলাদা কোনো পাঠ খুঁজে পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইটি নেই।
সুতরাং উপরিউক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটি স্পষ্ট যে, ঝর্ণার গল্প শীর্ষক ভাইরাল পৃষ্ঠাটি নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো বইয়ের পৃষ্ঠার নয়। এটি মূলত সরকারের জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পের কোর্সের বই ‘আমার জেমস ডায়েরি’ নামের একটি বইয়ের পৃষ্ঠা। জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটি ২০১৪ সালে প্রথম শুরু হয়। প্রথম পর্যায় শেষে ২০১৯ সালে প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হলেও বর্তমানে প্রকল্পটি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।