সাতই মার্চ সকালে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আওয়ামী লীগের বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ছাত্র নেতৃবৃন্দে ভরে যায়। উপস্থিত সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশে পরিণত করার ব্যাপারে আলোচনা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন সাহেবদের সঙ্গে লাইব্রেরিরুমে দ্বার রুদ্ধ করে আলাপে বসেন। সুদীর্ঘ আলোচনার পর লাইব্রেরিকক্ষ থেকে বসার ঘরে অপেক্ষারত আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, তাঁরা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন এবং ঐদিন বিকেল সাড়ে ৪ ঘটিকায় রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিতব্য সভায় দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে একটি চার দফার ঘোষণা দেওয়া হবে।
অতঃপর বঙ্গবন্ধু তৎমর্মে জনাব কামারুজ্জামান, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ড. কামাল হোসেনকে নির্দেশ দিয়ে গোসল ও দুপুরের আহারের জন্য বাড়ির ওপরতলায় চলে যান। আহার শেষে বঙ্গবন্ধু যখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, সে সময় এক ফাঁকে এসে ড. কামাল হোসেন তাঁকে প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখিয়ে নেন। ততক্ষণে আওয়ামী লীগের অপর পাঁচ নেতা নিজ নিজ বাসায় দুপুরের আহারের জন্য চলে গিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেন উপরোল্লিখিত ঘোষণাপত্রটি টাইপ করিয়ে নেওয়ার জন্য নিচে চলে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, আমি যেন ওই ঘোষণাপত্রটির টাইপড (চূড়ান্ত) কপিটি সেটির অনুমোদিত মূল খসড়াটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। ঘোষণাপত্রের খসড়াটি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী মোহাম্মদ হানিফকে টাইপ করার নির্দেশ দিয়ে ড. কামাল হোসেন আহারের জন্য তাঁর বাসায় চলে যান।
বেলা ৩টার দিকে প্রথমে আসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং এর একটু পরেই ড. কামাল হোসেন। আমি তখন ঘোষণাপত্রটির চূড়ান্ত কপিটি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অনুমোদিত খসড়া কপিটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলাম। একপর্যায়ে খন্দকার মোশতাক কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম যে ইশতেহারে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কি না। তিনি বলেন যে সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারীকৃত আইনগতকাঠামো (Legal Framework Order-LFO)-এর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা লঙ্ঘনসংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং এ ব্যাপারটা এই ইশতেহারে লেখা হয়নি। আমি ওই ইশতেহার পড়ে দেখলাম যে তাতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর যে সমস্ত আলাপ হয়েছে এবং ১ মার্চ থেকে গণ-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এবং বিরাজমান পরিস্থিতি ও ছাত্র-জনতার দাবি উল্লেখপূর্বক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতা হিসেবে চারটি দাবি উপস্থাপিত করেছেন। উক্ত ইশতেহারে ইয়াহিয়া খানের নিকট দাবি করা হয়। এক. সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, দুই. ১ মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে সে ব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, তিন. সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং চার. অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতার কাছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
ঠিক এ সময়ই বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে আয়োজিত জনসভায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে আরও ১০-১৫ জন ছাত্র ও আওয়ামী লীগের নেতা প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমি সভামঞ্চে পৌঁছার পূর্বেই তোমরা সভামঞ্চের চারদিকে উপস্থিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিকবৃন্দের মধ্যে এই ইশতেহারের কপি বিতরণ করবে।’ এ কথা বলে তিনি দোতলায় চলে যান। প্রায় আধঘণ্টা পর সাড়ে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু সভায় যাওয়ার জন্য আয়োজন করতে বলেন। হাসিনা, রেহানা, এ টি এম সৈয়দ হোসেন সাহেবের বড় মেয়ে শেলী ও শেখ শহীদের বোন জেলী আমার গাড়িতে উঠে বলে যে তাদেরও রেসকোর্সের জনসভায় নিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু একটি ট্রাকে ওঠেন। উক্ত ট্রাকে ছিলেন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মণি, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ডাকসুর প্রাক্তন সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। মোস্তফা মহসীন মন্টু, কামরুল আলম খসরু, মহিউদ্দিন, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজসহ আরও কিছুসংখ্যক আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা আর একটি ট্রাকে ছিলেন। নিরাপত্তার জন্য গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী অন্য যানগুলো চলে যাওয়ার পর আমি হাসিনা ও শ্যালিকাদের নিয়ে মিরপুর রোড দিয়ে যাত্রা করি। সিএসআইআরের মোড়ে পৌঁছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড ও আশপাশের রাস্তাগুলোয় রেসকোর্সে অভিগামী ছাত্র-জনতার মিছিলে পরিপূর্ণ থাকায় নিউমার্কেট, ইডেন কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে হাইকোর্ট এলাকা ঘুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কাছাকাছি যাই। সেখানে পৌঁছে দেখি রেসকোর্স লাখ লাখ লোকে পরিপূর্ণ এবং প্রায় সবার হাতে লাঠিসোঁটা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণ ছিল রায়ট পুলিশে ভর্তি।
সেদিন রেসকোর্স ময়দানে নৌকা আকৃতির সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিল বর্তমান শিশুপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। হাসিনার অনুরোধে আমি বহু কষ্টে সভামঞ্চের কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু তখনো সভামঞ্চে এসে পৌঁছাননি। এর প্রায় পনেরো মিনিট পর বঙ্গবন্ধু সদলবলে সেখানে পৌঁছান এবং মঞ্চে উঠে সবাইকে অভিবাদন জানান। হাসিনা আমাকে বলে, ‘বিভিন্ন সংবাদপত্রে লিখেছে, আব্বার আজকের সম্পূর্ণ বক্তৃতা রেডিওর মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।’ সে আমাকে গাড়ির রেডিও অন করতে বলে। রেডিওতে তখন বারবার এই মর্মে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যাহোক, বঙ্গবন্ধু প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা করেন এবং শেষ প্রান্তে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ এ কথার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা লাঠিসোঁটা ঠোকাঠুকি করে বিজয় উল্লাসে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা স্লোগান দিলে উপস্থিত জনতা জয় বাংলা স্লোগান তুলে প্রত্যুত্তর দেন। বঙ্গবন্ধু আবার জয় বাংলা বললে জনতা জয় বাংলা ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে তোলে। ‘খোদা হাফেজ’ বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন। সভা শেষে আমি হাসিনা ও শ্যালিকাদের নিয়ে একই রাস্তায় ৩২ নম্বরে ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধু প্রায় আধা ঘণ্টা পর বহু লোকজনসহ বাসায় ফিরে আসেন।
(বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৬৮-৭০)