হোম > ছাপা সংস্করণ

পাটের হালহকিকত

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

গরিব কৃষকের অবিস্মণীয় প্রতিনিধি শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের গফুর। গফুর এখনো আছে এবং আছে আগের দশাতেই। যন্ত্রণার ধরন বদলেছে, কিন্তু কারণ বদলায়নি। কারণ হলো সমাজব্যবস্থা।

এক শ বছর আগে গফুর রাতের অন্ধকারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে চলে গিয়েছিল শহরে। কাজ নেবে সে পাটের কলে। কিছুতেই যেতে চায়নি। পাটের কলের কুলিবস্তিতে তার মাতৃহীনা একমাত্র সন্তান আমিনার ইজ্জত বাঁচবে না বলে তার গভীর শঙ্কা ছিল। তবু যেতে হলো, কারণ ব্রাহ্মণ-জমিদার-শাসিত গ্রামে সে ভয়ংকর এক অপরাধ করে ফেলেছে, সে গরু হত্যা করেছে। গরুটা অন্য কারও নয়, তার নিজেরই; গরুর নাম রেখেছে সে মহেশ। মহেশ গফুরের অতি আপনজন। গফুরদের পূর্বপুরুষ ছিল তাঁতি; সেই তাঁত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এসে গিলে খেয়েছে, গফুরকে তাই কৃষক হতে হয়েছে। কিন্তু চাষবাসে যে উপকরণ লাগে, তা তার নেই। জমি নেই, লাঙলটা গেছে ভেঙে, ভরসা ছিল মহেশের ওপর, সে এখন বৃদ্ধ। গ্রামে ভীষণ খরা। পানীয় জলের অভাব। দূরের টিউবওয়েল থেকে জল আনতে আমিনার অনেক কষ্ট, গা বাঁচিয়ে চলতে হয়, ছুঁয়ে দিলে হিন্দু নারীদের জাত যাবে। গ্রীষ্মের ভরদুপুরে এক কলসি জল এনেছিল; অতিশয় তৃষ্ণার্ত মহেশ সেই জল খেতে গিয়ে আমিনার কলসি দিয়েছে ভেঙে। রাগে, অভিমানে, দুঃখে অন্ধ গফুর তার ভাঙা লাঙলের ফালটা এনে মেরেছে মহেশের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মহেশের মৃত্যু এবং তারপর গ্রাম ছেড়ে গফুরের পলায়ন।

তা সেকালের গফুরের তবু ভরসা ছিল পাটকলে। গফুর পশ্চিমবঙ্গের লোক, বাস কলকাতার কাছেই। রাজধানী কলকাতার আশপাশে তখন অনেক পাটকল।

পাট যেত পূর্ববঙ্গ থেকে, কল ছিল কলকাতায়। দেশভাগের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের বিক্রয়যোগ্য সম্পদ বলতে ছিল ওই পাটই। কিন্তু সেই পাট বিক্রির সুফল পূর্ববঙ্গ পেত না, সেটা চলে যেত করাচিতে, তারপর গেল রাওয়ালপিন্ডিতে। রাওয়ালপিন্ডিতে নতুন একটা রাজধানীই বানানো হয়েছিল, তাতে অংশ ছিল পাট-বেচা টাকার। পাটের টাকা সমরাস্ত্র কেনাতেও লাগল, একাত্তরে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে হতভাগ্য পূর্ববঙ্গেই। গফুর পশ্চিমবঙ্গের লোক বলে তবু যাহোক পাটকলে কাজ পেয়েছে, যদি এখনকার পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা হতো, তবে তা-ও কিন্তু পেত না।

পাট আছে, অথচ পাটকল নেই, এই ফাঁকা অবস্থায় সাতচল্লিশের পরে পূর্ববঙ্গে কয়েকটি পাটকল তৈরি হয়েছিল; ভালো মুনাফা হবে জেনে বিখ্যাত সেই বাইশ পরিবারের দু-তিনজন অর্থ বিনিয়োগ করেছিল পাটশিল্পে। ভালো মুনাফা আসছিল। আদমজীদের পাটকলকে তো বলা হতো শুধু এশিয়ার নয়, বিশ্বেরই সেরা। একাত্তরের স্বাধীনতার পরে অনেকগুলো পাটকলই বন্ধ হয়ে গেছে। আদমজীর পতনটা তো পর্বতসম। শ্রমিকদের কারণে আদমজী পড়েনি, পড়েছে ব্যবস্থাপনার কারণে। বাঙালি ব্যবস্থাপকেরা স্বাধীনতা পেয়ে এমন লুটতরাজ শুরু করে দিল যে মুনাফা দূরে থাক, লোকসান সামাল দেওয়াই ‘অসম্ভব’ হয়ে পড়েছিল। আদমজী পড়ে গেল; কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল সীমান্তের ওপারে, পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন পাটকল খোলার রীতিমতো ধুম পড়ে গেছে। পাট কিন্তু যাচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই। যেন সেই পুরোনো ব্যবস্থা; কাঁচামাল এধারের, কারখানা ওধারে। আদমজীর অবাঙালি জেনারেল ম্যানেজারটি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ব্যক্তি, স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওপারে চলে গেছেন এবং ওপারের শিল্পপতিরা তাঁকে লুফে নিয়েছেন। এটা স্বাধীনতা-পরবর্তী কথিত পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের অংশ কি না, কে বলবে।

স্বাধীন বাংলায় দেখা গেল পাটকলগুলো একে একে হয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নয়তো চলে যাচ্ছে বেসরকারি মালিকানায়। বোঝা গেল পুঁজিবাদ এখন মুক্তি পেয়েছে, সে কোনো বাধা মানবে না, তার নির্মম তৎপরতা সে দেখাবে। রাষ্ট্রীয় কারখানা যে প্রাইভেট হবে, এটা ছিল সরকারি নীতি, স্বাধীনতার পর কয়েকবার সরকার বদল হয়েছে কিন্তু নীতির কোনো বরখেলাপ হয়নি। রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানা ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তরে কিন্তু মুখ্য ভূমিকা নিল তারাই, যাদের ওপর দায়িত্ব ছিল সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের। বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের কেউ নগদ টাকা ঘুষ পেল, কেউ-বা পেল কলের মালিকানা; ভালো মানুষ যাঁরা অল্পস্বল্প ছিলেন, তাঁরা দেখলেন নয়ন ভরে। নদী খেপে উঠেছে, পাড় ভাঙবে, সামলায় কার সাধ্য?

একাত্তরের স্বাধীনতার পরে এমনও শুনেছি যে পাটের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, হাঁটবে একদা-বিখ্যাত সেই নীলের পথেই। কিন্তু পড়ে যায়নি, টিকে গেছে।

কারণ, পাটের গুণ আছে। পাট প্রকৃতিবান্ধব। তার বিপরীতে পলিথিন ও প্লাস্টিক প্রকৃতির সঙ্গে শত্রুতা করে অনবরত। আর পাট থেকে যে কেবল চট-ছালা তৈরি হয় তা তো নয়, কার্পেট হয়, কাপড় হয়, আসবাবও হয়। পাট তাই পড়ে যায়নি। অন্য দেশেও এখন বিলক্ষণ পাটের চাষ চলছে। কিন্তু তবু বিশ্বের শতকরা ৫০ ভাগ পাট এখনো বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়। তবে অন্যান্য দেশ তাদের পাট বিদেশে রপ্তানি করতে চায় না, ভারত তো রপ্তানি করেই না; বাংলাদেশ করে। বিশ্বে এ এক বিরল ঘটনা যে একটি দেশ তার নিজের দেশের কাঁচামাল নিজের কাজে না লাগিয়ে ভিনদেশে পাঠাচ্ছে। বেশির ভাগ পাটই রপ্তানি হয় আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু ও বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতে। ভরা মৌসুমে ভারত সস্তা দরে পাটের সর্বোৎকৃষ্ট চালানটি নিয়ে যায়; বাংলাদেশের জন্য পড়ে থাকে নিকৃষ্টতম অংশ, যা দিয়ে উৎকৃষ্ট পণ্য উৎপাদন অসম্ভব। তথ্যাভিজ্ঞরা বলেন যে বিশ্বে এখন মোট যত কাঁচা পাট রপ্তানি হয়, তার শতকরা ৭৮ দশমিক ৫৪ ভাগই যায় বাংলাদেশ থেকে। পাটদ্রব্যের বাজার বাড়ছে, কিন্তু সে বাজারে বাংলাদেশ কোণঠাসা; কারণ একদিকে তার পাটপণ্য উন্নত মানের নয়, অন্যদিকে বাজারে ঢোকার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা নেই।

সরকারি পাটকল যে লোকসান গুনছে তার প্রধান কারণ ব্যবস্থাপকদের দুর্নীতি। বাজারে এরা পাট কিনতে আসে দেরিতে, ততক্ষণে ভালো পাট বিক্রি হয়ে গেছে। তারা নিম্নমানের পাট সস্তায় কেনে কিন্তু কাগজে-কলমে দাম দেখায় উঁচুমাত্রার। পাট কেনে পাটকলের আশপাশের এলাকা থেকেই, খাতায় লেখে কিনেছে দূরদূরান্ত থেকে, যাতে যাতায়াত ও যানবাহন খরচ পড়েছে ভালো রকমের। উদ্বৃত্ত টাকা তাদের পকেটে চলে যায়। লোকসান হয়ে পড়ে অনিবার্য। ফলে শ্রমিক-কর্মীদের বেতন বকেয়া পড়ে; নিরুপায়ে শ্রমিক-কর্মচারীরা ধর্মঘট করেন, উৎপাদন বন্ধ থাকে, লোকসান বাড়ে এবং ক্ষেত্র তৈরি হয় মিলে তালা ঝোলানোর, নয়তো প্রাইভেটের কাছে পানির দরে বিক্রি করে দেওয়ার।

তুলনায় প্রাইভেট মিলগুলো ভালো করছে। তার প্রধান কারণ তারা সস্তায় শ্রমিক খাটায়। তারা গফুরকে নয়, চায় গফুরের কিশোরী মেয়ে আমিনাকে; কারণ আমিনা দর-কষাকষি করতে জানে না, আর সে রাজি না হলে অন্য আমিনারা তো মজুত রয়েছে কাছেই। আমিনা কাজ করবে ক্রীতদাসীর মতো, চা-বাগানের মজুরেরা যেভাবে করে। প্রাইভেটের মুনাফার আরেক রহস্য ট্যাক্স ফাঁকি। এ ব্যাপারে তাদের দক্ষতা অপরিসীম। ওদিকে আবার বাজার থেকে তারা পচা পাট কেনার কথা ভাবতেই পারে না, কেনে সর্বোৎকৃষ্টটাই, ফলে উৎপাদিত পণ্যের মান ভালো হয়। আবার এমনও শোনা যায় যে পণ্যের গায়ে কেউ কেউ ভারতের ছাপও মারে, বাজারের আশায়।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ