ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খান। বরেণ্য এই শিক্ষা উদ্যোক্তা বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতিরও সভাপতি। দেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতের সামগ্রিক উন্নয়নে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি, বৈশ্বিক মান, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনসহ নানা বিষয় নিয়ে আজকের পত্রিকার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিক্ষা ও ক্যারিয়ার বিভাগের ইনচার্জ আব্দুর রাজ্জাক খান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতি বেশি হয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে? এখনো কোন ক্ষেত্রগুলোতে উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন?
বেশি অগ্রগতি হয়েছে আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে। যেমন টাইমস হায়ার এডুকেশন এবং কিউএস র্যাঙ্কিংয়ে স্থান অর্জন। এর পাশাপাশি দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষা, ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া সংযোগ এবং প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা, যেমন এলএমএস, স্মার্ট ক্লাসরুম, মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়ালে উন্নয়ন ঘটেছে। চাকরিমুখী প্রোগ্রাম, ইন্টার্নশিপ এবং গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্টের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে এসডিজি-ভিত্তিক কার্যক্রম, সবুজ ক্যাম্পাস এবং গবেষণা পরিমণ্ডলেও অগ্রগতি হয়েছে।
তবে এখনো কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন প্রয়োজন। যেমন গবেষণা ও বিশেষায়িত ল্যাব-সুবিধা, আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি এবং পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকের সংখ্যা, যৌথ গবেষণার জন্য তহবিল এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা-উদ্ভাবন সংস্কৃতি বৃদ্ধি। সব বিশ্ববিদ্যালয় সমানভাবে এগোয়নি। তাই কাঠামোগত সহায়তা ও নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে এগুলোকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন।
বৈশ্বিক মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
বাংলাদেশে বৈশ্বিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন—
* স্বতন্ত্র হায়ার এডুকেশন কমিশন: বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, মান, গবেষণা, র্যাঙ্কিং এবং আন্তর্জাতিকীকরণের বিষয়গুলো দেখবে।
* নিয়মকানুনের সরলীকরণ: প্রতিটি অনুমোদনপ্রক্রিয়া ডিজিটাল ও সময়নিষ্ঠ হতে হবে।
* জাতীয় গবেষণা তহবিল: বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক নয়, জাতীয় পর্যায়ে তহবিল গঠন প্রয়োজন।
* ইন্ডাস্ট্রি-লিংকেজ বাধ্যতামূলক: প্রতিটি বিভাগে ইন্টার্নশিপ, ক্যাপস্টোন এবং শিল্পভিত্তিক প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত থাকা।
* আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ডিগ্রি, কারিকুলাম এবং গবেষণায় যৌথ উন্নয়ন।
* ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট: বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, পোস্ট-ডক স্কলারশিপ।
নতুন প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও গবেষণায় বেসরকারি অগ্রগতির জন্য আপনার পরামর্শ কী?
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), বিগ ডেটা, IoT, ক্লাউড—এসব বিষয়ে বাস্তবমুখী ল্যাব স্থাপন জরুরি। এ ছাড়া ক্যাপস্টোন-ভিত্তিক শিক্ষা চালু করা উচিত, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী সমস্যা সমাধানভিত্তিক প্রকল্প সম্পন্ন করবে। স্টার্টআপ ইনকিউবেটর এবং ভেঞ্চার ক্যাপিটালের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) নলেজভেল, ডিবিআই এবং বিভিসিএল মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সহযোগিতা এবং যৌথ প্রকাশনা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের জন্য ইন্ডাস্ট্রি ট্রেনিং এবং গ্লোবাল সার্টিফিকেশন। গবেষণায় এআই টুল ব্যবহারের প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি ও সম্পর্ক কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শক্তিশালী করছে?
এটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান এবং সক্ষমতা শক্তিশালী করে। এর মাধ্যমে যৌথ গবেষণা ও কো-অথরড প্রকাশনার সুযোগ তৈরি হয়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের বিনিময় সম্ভব হয় এবং গ্লোবাল কারিকুলাম স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা যায়। এ ছাড়া, ডাবল বা জয়েন্ট ডিগ্রির সুযোগ, আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি ও স্কলারের আকর্ষণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের সম্পর্ক কার্যকর ভূমিকা রাখে।
উদাহরণস্বরূপ, ডিআইইউ ইতিমধ্যে ৪৫০টির বেশি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা স্থাপন করেছে। এটি বৈশ্বিক সংযোগ শিক্ষার মান উন্নয়নের সবচেয়ে দ্রুত এবং কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।
আশুলিয়াকে ‘উচ্চশিক্ষার শহর’ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এই উদ্যোগ কত দূর এগিয়েছে?
পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এই উদ্যোগের আওতায় যৌথ পরিকল্পনা, গবেষণা—ক্লাস্টার গঠন, যৌথ ল্যাব স্থাপন, স্টুডেন্ট ও ফ্যাকাল্টি শেয়ারিং মডেল এবং বড় পরিসরের ইনোভেশন পার্ক তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। এই উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে আশুলিয়া হবে দেশের প্রথম হায়ার এডুকেশন হাব। এখানে শিক্ষা, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম একসঙ্গে বিকশিত হবে।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার মান ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা কী?
বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমত, বিভাগীয় শহরে দক্ষতা-ভিত্তিক ক্যাম্পাস স্থাপন এবং টিভেট ও মাইক্রো-ক্রেডেনশিয়াল শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম যেমন গোএডু ও আইওইউ সম্প্রসারণ। এর মাধ্যমে শিক্ষাকে আরও সহজলভ্য করা যাবে। তৃতীয়ত, স্থানীয় শিল্প ও কারখানার সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলা। এ ছাড়া, গ্রামপর্যায়ে উদ্যোক্তা ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করা। আমাদের লক্ষ্য শুধু ঢাকাকে শিক্ষার কেন্দ্র বানানো নয় বরং পুরো বাংলাদেশকে শিক্ষার শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করা।
শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা মনোভাব গড়ে তুলতে কী কর্মপরিকল্পনা আছে?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক উদ্যোক্তা শিক্ষা, স্টার্টআপ ইনকিউবেটর এবং সিড ফান্ড সহযোগিতা। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল লিমিটেড মডেল এবং আন্তর্জাতিক স্টার্টআপ ইভেন্ট যেমন গ্লোবাল এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ উইক, হ্যাকাথন এবং পিচিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ৩৬০ ডিগ্রি প্রোগ্রামের মাধ্যমে তারা উদ্যোক্তা দক্ষতা, নেতৃত্ব ও ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনায় সমন্বিত অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে। আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষার্থীরা শুধু চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং চাকরি সৃষ্টিকারী ও উদ্ভাবনী তরুণ হিসেবে গড়ে উঠবে।
নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে কী পরামর্শ দেবেন?
প্রতিষ্ঠান শুরু হওয়ার প্রথম দিন থেকে মানকেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করা উচিত। ডিজিটাল উপস্থিতি, যেমন এলএমএস, ইআরপি ও অটোমেশন সিস্টেম ব্যবহারে জোর দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি-সংযুক্ত কারিকুলামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তব অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা। পিএইচডিধারী শিক্ষক নিয়োগ, গবেষণা ইথিকস ও একাডেমিক ইনটিগ্রিটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার মান ধরে রাখা সম্ভব। এ ছাড়া, এসডিজিবেইজড কার্যক্রমকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা হলো দেশের ভবিষ্যৎ এবং এখানে কোনো আপস করা যাবে না।
আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোথায় দেখতে চান?
অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় কিউএস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ৫০০-তে পৌঁছাক। দেশজুড়ে গবেষণা ক্লাস্টার এবং শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি-ইনোভেশন ক্যাম্পাস তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া, এআই ও পঞ্চম শিল্পবিপ্লবচালিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য আকর্ষণীয় কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা অন্যতম লক্ষ্য। এ ছাড়া দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্থনীতিতে দক্ষ মানবসম্পদের মূল উৎস হিসেবে কাজ করবে। সবশেষে, আশা করা যায়, বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হায়ার এডুকেশন মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং শিক্ষার মান, গবেষণা ও উদ্ভাবনে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।