দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট কাটাতে এবং ভেঙে পড়া শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আরও কঠোর ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি জানিয়েছেন, ব্যাংক খাতের বড় অনিয়ম ধরতে ২০ কোটি টাকার বেশি অঙ্কের সব ঋণ নতুন করে যাচাই করা হবে। পাশাপাশি ধুঁকতে থাকা ৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়ন এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে সব ধরনের আইনি জটিলতা দূর করা হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ব্যাংকিং খাত সংস্কার: চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
গভর্নর জানান, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ফেরাতে বড় অঙ্কের ঋণগুলোর ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০ কোটি টাকার বেশি সব ঋণ নতুন করে যাচাই করা হবে। এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। যদি জামানত ঠিক না থাকে, তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ব্যাংক পরিচালকদের কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনা হবে।
সেমিনারে গভর্নর জানান, পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার পাশাপাশি ৯টি অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) অবসায়ন করা হচ্ছে। তবে আমানতকারীদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের সব সাধারণ আমানতকারী তাঁদের জমানো পুরো টাকা ফেরত পাবেন। প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা তাঁদের অর্থের একটি অংশ ফেরত পাবেন। এ লক্ষ্যে পাঁচ ব্যাংকের গ্রাহকদের টাকা ফেরতের সুবিধার্থে ইতিমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
ড. মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে নতুন আইনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও একজন ভালো নেতা দরকার। এই সরকার যদি প্রস্তাবিত আইনটি পাস করে দেয়, তবে ব্যাংকিং খাতে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। তিনি আরও যোগ করেন, মন্ত্রীর কথায় যেন গভর্নরকে বরখাস্ত না করা যায়, এমন আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আসন্ন নির্বাচন একটি সন্ধিক্ষণ। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, রাজনৈতিক নেতারা কি আগের মতো ক্ষমতাশালী পুঁজিপতিদের হাতে ব্যাংক ছেড়ে দেবেন, না জনগণের কল্যাণে ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পুঁজিতে এই খাত ব্যবহার করবেন?
সেমিনারে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলের মাধ্যমে মূলত ব্যাংক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়ে এবং খেলাপি ঋণ ৩৬ শতাংশে পৌঁছায়। এখন যে সংস্কার হচ্ছে, পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার তা কতটা এগিয়ে নেবে—সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত হার ৩৬ শতাংশ বলে স্বীকার করেন ড. মনসুর। এ সংকট কাটাতে তিনি বড় ঋণের জন্য ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড মার্কেটের বিকাশের ওপর জোর দেন। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক মানের আর্থিক খাত গড়তে অন্তত ১০ বছর সময় লাগতে পারে, তবে সঠিক পথে হাঁটা শুরু হয়েছে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ইআরএফ সভাপতি দৌলত আক্তার এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।