ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রাম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এখানকার দুই শতাধিক পরিবার মাটির তৈজসপত্র তৈরি করছেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বাজারের পরিবর্তন আর পুরোনো নকশার কারণে সেই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প এখন যেন হারিয়ে যাচ্ছিল।
এই বাস্তবতা বদলাতে এক নতুন উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি মৃৎশিল্পীদের দক্ষতা উন্নয়ন, মান উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণবিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে পাল সম্প্রদায়ের শিল্পীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে আধুনিক কৌশল, উন্নত বিপণনের ধারণা আর নতুন প্রেরণা।
জেলা পরিষদের অর্থায়নে ১০ দিনের এই প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হয়েছে ২০ জন শিল্পীকে নিয়ে। এই প্রশিক্ষণে তাঁরা প্রথমে মৌলিক ধারণা লাভ করবেন, এরপর দক্ষতা বৃদ্ধি, উন্নত উৎপাদন এবং সর্বশেষ ধাপে বাজারজাতকরণ কৌশল শিখবেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই ২০ শিল্পী পরে আরও ২০০ স্থানীয় শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেবেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে এই কর্মশালার অগ্রগতি দেখতে পালপাড়া গ্রাম পরিদর্শন করেন ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মেহনাজ ফেরদৌস।
জেলা প্রশাসক বলেন, পালপাড়ার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাজার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় তাদের পণ্য বিক্রি কমেছে। এখন সময় এসেছে তাদের শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষকের মাধ্যমে আধুনিক রূপে ফিরিয়ে আনার।
এই কর্মশালার নেতৃত্বে রয়েছেন আড়ংয়ের সিনিয়র কনসালট্যান্ট চন্দ্র শেখর সাহা, যিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। সহকারী প্রশিক্ষক আশরাফুল শাওন এবং সমন্বয়ক মোছা. শরিফা খাতুনের তত্ত্বাবধানে চলছে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ।
সমন্বয়ক শরিফা খাতুন জানান, আগে একটি ফুলদানি হাতে বানানোর কারণে এর দাম ছিল ১০০ টাকা, এখন উন্নত নকশা ও মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একই পণ্য ৫০০ টাকায় বিক্রির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
মৃৎশিল্পীরা এখন তৈরি করছেন আধুনিক নকশার ফুলদানি, মেয়েদের গয়না রাখার বাক্স এমনকি মাটির গয়নাও। একসময় বিক্রি না হওয়া সাধারণ চায়ের কাপ, পিরিচ আর কেটলির সেট এখন এমনভাবে সাজানো হচ্ছে, যা হাজার টাকা দামে বিক্রির আশা জাগাচ্ছে।
প্রশিক্ষণার্থী রাধারানী পাল বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকে মাটির কাজ করি, কিন্তু কখনো ভাবিনি এটা দিয়েও ভালো আয় করা যায়। এখন বুঝছি নতুন নকশা, নতুন ভাবনা নিয়ে কাজ করলে এই শিল্প দিয়েও সংসার চলতে পারে।’
আরেক শিল্পী দ্বিজেন পাল হাসিমুখে বলেন, ‘আগে ফুলদানি বানাতাম শুধু স্থানীয় হাটে বিক্রির জন্য। এখন শেখানো হচ্ছে কীভাবে এটাকে শোপিসে রূপ দেওয়া যায়। এখন মনে হচ্ছে, আমাদের কাজও বড় দোকানে জায়গা পেতে পারে।’
প্রশিক্ষণ শেষে এই নতুন পণ্যগুলো জেলা পর্যায়ে প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা হবে। পরবর্তী ধাপে মাসব্যাপী আরও বিস্তৃত কোর্স আয়োজনের পরিকল্পনাও রয়েছে জেলা প্রশাসনের।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিক, টিটিসি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আড়ংয়ের সহযোগিতায় এই পণ্যগুলো বৃহত্তর বাজারের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে।
প্রশিক্ষণার্থী রাধারানী পাল, দ্বিজেন পাল, পঞ্চমী পাল, বৃষ্টি ঊর্মিলা, রত্না ও অতুল পালের চোখে এখন একটাই স্বপ্ন, ‘আমাদের পণ্য শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, ঢাকায় এমনকি দেশের বাইরেও বিক্রি হোক।’
জেলা প্রশাসক ইশরাত ফারজানা বলেন, ‘মৃৎশিল্প শুধু একটা পেশা নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতেই আমরা এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছি। এর মাধ্যমে পাল সম্প্রদায়ের জীবনে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।’