সময়ের পরিক্রমায় প্রকৃতিতে এখন হেমন্ত। পঞ্জিকা অনুযায়ী আর দিন কুড়ি পরই শুরু হবে শীত। তবে তার আগেই শীত অনুভূত হচ্ছে। দিনে তেমন না হলেও রাতে শীত নিবারণে কাঁথা কিংবা কম্বল জড়াতে হচ্ছে শরীরে। সে সঙ্গে বেড়েছে কাঁথা কিংবা কম্বল তৈরির কারিগরদের ব্যস্ততা।
সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার কম্বলপল্লিও এখন সরগরম। বিরামহীন কাজ করছেন কারিগরেরা। বিক্রিও হচ্ছে দেদার। অনলাইনেও বিক্রি করছেন অনেকেই। অনলাইনে কম্বল বিক্রেতা হালিম বলেন, ‘সরাসরি বিক্রির পাশাপাশি অনলাইনেও বিক্রি করি। আমাদের একটা ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে ভালো সাড়া পাচ্ছি। প্রতিদিন অন্তত দুই ট্রাক কম্বল ডেলিভারি হয়।’
নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা থেকে পরিত্যক্ত কাপড় কিনে এনে তৈরি করা হয় জোড়া কম্বল। এই কম্বল সেলাই করেই এলাকার হাজারো মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছেন।
কেননা উপজেলার বরশিভাঙ্গা, শিমুলদাইড়, সাতকয়া, শ্যামপুর, ছালাভরা, কুনকুনিয়া, গাড়াবেড়, চকপাড়া, পাইকরতলী, ঢেকুরিয়া, বরইতলা, মুসলিমপাড়াসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের ৩০-৩৫ হাজার মানুষ এখন কম্বল তৈরির সঙ্গে জড়িত। আর এই কম্বলশিল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে শিমুলদাইড় বাজার।
কম্বলপল্লি খ্যাত এই উপজেলায় এই যে ব্যস্ততা, তা হঠাৎ করে শুরু হয়নি। ৪০ বছর আগে উপজেলার বরশিভাঙ্গা গ্রামের সাইদুল হক কাজের সন্ধানে গিয়েছিলেন রাজধানীর মিরপুরে। সেখানে পোশাক কারখানায় কিছুদিন কাজ করার পর পরিত্যক্ত ঝুট কাপড় কিনে নিয়ে এলাকায় গিয়ে শুরু করেন কম্বল তৈরি।
সেই কম্বল সাইকেলে করে বিক্রি করতেন গ্রামে গ্রামে। তাঁর দেখাদেখি কাজীপুরে কম্বল তৈরি শুরু করেন অনেকেই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। মূলত সাইদুলের হাত ধরেই কাজীপুর পরিচিতি পেয়েছে কম্বলপল্লি নামে।
বর্তমানে শিমুলদাইড় বাজারে জোড়া কম্বলের জন্য প্রয়োজনীয় পরিত্যক্ত কাপড় বিক্রি করছেন সাইদুল। তিনি বলেন, ‘আমি ওই সময় ঢাকা গিয়ে দেখি মিরপুরের ১০ নম্বরে ঝুট কাপড় পাওয়া যায়। তখন আমি তিন বস্তা কাপড় কিনে বাড়িতে এনে সেলাই মেশিনে জোড়া দিয়ে কম্বল তৈরি করি। পরে সেগুলো সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করি। দেখি ভালোই চলে। এরপর আমার দেখাদেখি অনেকেই ব্যবসা শুরু করেন। আর্থিক সংকটের কারণে ব্যবসা বড় করতে পারিনি।’
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৩০-৩২০ টাকা কেজি দরে কম্বল তৈরির রোল কাপড় কেনা হয়। ওজন ভিত্তিতে প্রতি কেজি কাপড় থেকে ৩ থেকে ৫টি কম্বল তৈরি হয়। মানভেদে প্রতিটি কম্বল ১২০-৮০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। আর জোড়া কম্বল তৈরি করা হয় গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত কাপড় দিয়ে। সেগুলো মানভেদে ১৫০-৪০০ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
গাড়াবেড় গ্রামের নুরুল ইসলাম ছোটদের পায়জামা আর হুডি তৈরি করে এলাকায় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছেন। নুরুল ইসলাম বলেন, ‘পায়জামা ও হুডি তৈরি করে শিমুলদাইড় বাজারে ৯ টাকা-৪৮ টাকা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি করি প্রতিটি।’
মূলত বছরের জুলাইয়ে শুরু হয় কম্বল তৈরি। আর তৈরির কাজ চলে পরবর্তী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। অর্থাৎ ৬ মাস কম্বল ও শিশুদের শীতবস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন এখানকার কারিগর ও শ্রমিকেরা। গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে জোড়া কম্বল তৈরি করেন গাড়াবেড় গ্রামের ফোলেরা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আগে পায়ের মেশিন আছিল। তহন দিনে ৩ থেকে ৪টা কম্বল বানাছি। ১৫ টাকা করে মজুরি দিত। এহন কারেনের মেশিন কিনছি। সারা দিন কাম করলি দুই-আড়াই শ হয়। এই টাকা দিয়েই পোলাপানের পড়াশোনার খরচ, পরিবার চালাই।’
ছালাভরা গ্রামের আছিয়া বলেন, ‘২০ বছর ধরে জোড়া কম্বল বানাই। প্রতি কম্বলে মজুরি পাই ৩০ টাকা। একটা মেয়ে বিয়া দিছি, ছেলেকেও আইএ পাস করাছি। এ কাজ করে সবাই পরিবারের উন্নতি করতেছে।’
এদিকে, বছরখানেক আগে উপজেলার শিমুলদাইড় বাজারে কম্বল তৈরির একটি আধুনিক কারখানাও গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি সে কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, শ্রমিকদের দম ফেলার ফুরসত নেই। বাহারি সুতায় বোনা হচ্ছে রঙিন কম্বল। সেই কম্বল বিভিন্ন মাপে কেটে সেলাইমেশিনে দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। সেগুলোর মুড়ি সেলাই করছেন কারিগরেরা। পরে ভাঁজ করে বিশেষ ব্যাগে ভরে গুদামে রাখছেন। পাইকাররা দেখছেন, দরদাম করছেন। দামে বোনলেই কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন।
মেসার্স সহি ট্রেডার্স নামের ওই কারখানার স্বত্বাধিকারী শরিফুল ইসলাম সোহেল বলেন, ‘আমাদের এই কম্বলপল্লিতে বর্তমানে ১৬৬ আইটেমের শীতের কাপড় তৈরি হয়। আশা করছি, এবারের মৌসুমে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হবে এ পল্লিতে। ব্যবসায়ীরা যদি স্বল্প সুদে ঋণ পেতেন তাহলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটত। পাশাপাশি নিরাপদে টাকা লেনদেনের জন্য এই বাজারে একটা ব্যাংকের শাখা খুবই প্রয়োজন।’