'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
একেবারে উড়ে যায়, কোথা পাবে পাখা সে'
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি তাল গাছের দৃশ্য এখন আর গ্রাম বাংলায় তেমন চোখে পড়ে না। আদিকাল থেকে গ্রামবাংলার শোভা বৃদ্ধিতে সারি সারি তালগাছের ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুলসহ বিভিন্ন গ্রাম ও স্থাপনা চেনানোর ক্ষেত্রে তালগাছের অবস্থান চিহ্নিত করা হতো। এমনকি সরকারি-বেসরকারি কাজে নানান দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রেও তালগাছের অবস্থান সহায়তা নেওয়া হত।
কালের আবর্তে নামি দামি কাঠগাছের গুরুত্বের কাছে আজ তালগাছ প্রকৃতি থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অবহেলিতভাবে দু’একটি তালগাছ চোখে পড়লেও এখন আর আগের মতো গ্রামের ঝোপ-ঝাড়ে বা সড়ক মহাসড়কের পাশে অহরহ দেখা যায় না। তালগাছ নির্বিচারে উজাড় করার ফলে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ চোখে পড়ার মতো হলেও গ্রামবাংলার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ‘তাল গাছ’ রক্ষায় তেমন পদক্ষেপ না থাকায় ক্রমেই এটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তবে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে দেখা গেছে এর ব্যতিক্রম।
সরেজমিন চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ভারত লাগোয়া জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়নের সাতঘরিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সড়কের দু’পাশে সারি সারি তাল গাছ। এমনকি বাড়ির আঙ্গিনায়ও ছোট-বড় তাল গাছে ঘেরা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। দৃশ্যটি দেখে যে কেউ আকৃষ্ট হবেন। মনে করিয়ে দেয় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আকাশ ছুঁই ছুঁই সারি সারি তালগাছের সদৃশ কবিতাটির চরণ। আর এই দৃশ্যটি ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করতে বিভিন্ন এলাকা থেকে এই গ্রামে ছুটে আসেন তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ।
সাতঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি জানান, জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়নের মধ্যে আমাদের গ্রামটি আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরা গ্রামটি। যা নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি। সময়ের পরিবর্তনেও নামি দামি কাঠগাছের কাছে হার মানেনই এই গ্রামে রূপিত তালগাছ। বর্তমানে সারি সারি তালগাছ আমাদের গ্রামের নান্দনিকতা বৃদ্ধি করেছে। গ্রামটি ভারত লাগোয়া হলেও আদিকাল থেকেই এই গ্রামের বাসিন্দারা তালগাছ রোপণে যেমন আগ্রহী ছিল বর্তমান প্রজন্মও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে।
তিনি আরও জানান, এই গাছগুলি গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে যেমন ভূমিকা রেখেছে তার চেয়েও বড় ভূমিকা রাখছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বজ্রপাত) মোকাবেলায়। যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন গাছ রোপণের পাশা-পাশি তিনি দেশবাসীকে তালগাছ রোপণের আহবান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে কুমিল্লা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম জানান, অতীতে কখনো তালের চারা রোপণ বন বিভাগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তবে এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় তালের বীজ সংগ্রহের জন্য মাঠ পর্যায়ে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এবছর তিন জেলার গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক চারা রোপণ করতে পারবো বলে তিনি জানান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক দিলিপ কুমার অধিকারী জানান, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার কর্মকর্তাদের স্ব-উদ্যোগে গত বছর কুমিল্লা লালমাইসহ ১৭ উপজেলায় ২৫০ কিলোমিটার জনপদে ৩০ হাজার ৪৫০টি তালের চারা রোপণ করা হয়েছে। আশা করছি সরকারি অর্থ বরাদ্দ পেলে চলতি বছর এর চাইতেও কয়েকগুণ বাড়তি বীজ রোপন করতে পারবো।
তিনি আরও জানান, তালগাছ বজ্রপাত নিরোধক ও পরিবেশ বান্ধব গাছ। তালগাছ নির্বিচারে উজাড় করার ফলে বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এই ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে তিনি সকলকে অন্যান্য গাছের পাশাপাশি তালগাছ রোপণেরও অনুরোধ জানিয়েছেন।