হোম > বিশ্লেষণ

ফিলিস্তিনে স্থায়ী শান্তির পথে বাধা ‘পাগল রাষ্ট্র’ ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ সম্পর্ক’

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ফিলিস্তিনে শান্তির পথে বাধা ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ নজর। ছবি: সংগৃহীত

গাজায় হত্যাযজ্ঞ অন্তত সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছে। ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দী ব্যক্তিদের বিনিময় শুরু হয়েছে এবং ত্রাণ সহায়তাও এখন কিছুটা সহজে পৌঁছাতে পারছে বিপর্যস্ত গাজার মানুষের কাছে। এর জন্য আমরা সবাই কৃতজ্ঞ হতেই পারি। স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধবিরতিকে তাঁর সাফল্য হিসেবে দেখাচ্ছেন এবং এটিকে ‘নয়া মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক ভোর’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। তবে এ রকম কথা তিনি আগেও বলেছেন, তাঁর আগের প্রেসিডেন্টরাও বলেছেন। আশা করি, এবার তাঁর কথাটা সত্যি হবে, কিন্তু খুব বেশি বাজি ধরতে রাজি নই।

এই যুদ্ধবিরতির পরও দুটি বড় প্রশ্ন ঝুলে আছে। প্রথম প্রশ্নটা স্পষ্ট—‘এই চুক্তি টিকবে তো?’ আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি আসলে প্রথমটার উত্তর নির্ধারণ করে। প্রশ্নটি হলো—ইসরায়েলের সঙ্গে বিশ্বের বাকি দেশগুলোর, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সম্পর্কের পরিবর্তন কি এমন পথে এগোচ্ছে, যাতে ফিলিস্তিনে বহু প্রতীক্ষিত স্থায়ী শান্তি সম্ভব হয়?

প্রথম প্রশ্নের জবাবে আশাবাদী হওয়া কঠিন। অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, এই ‘শান্তি পরিকল্পনা’ তৈরি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একদল কট্টর ইসরায়েলপন্থী মধ্যস্থতাকারী। তাঁদের মধ্যে ট্রাম্পের বন্ধু স্টিভ উইটকফ ও জামাতা জ্যারেড কুশনার অন্যতম এবং সেখানে ফিলিস্তিনিদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপটি আসলে একধরনের আলটিমেটামের মতো, আলোচনার ফল নয়। এতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থীদের কিছু চরম দাবি, যেমন গাজা দখল ও সেখানকার বাসিন্দাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ প্রত্যাখ্যান করা হলেও ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু প্রায় অসম্ভব শর্ত, যেমন হামাসকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করা, সব টানেল ধ্বংস করা, তাদের রাজনীতির বাইরে রাখা এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বড় ধরনের কিন্তু ‘অস্পষ্ট সংস্কার’ করা। এখনো গঠিত হয়নি, কীভাবে গঠিত হবে তা-ও স্পষ্ট নয়—এমন একটি ‘পর্যবেক্ষণ সংস্থা’ নজরদারি করবে কে চুক্তি মানছে আর কে মানছে না। এই পর্যবেক্ষণ সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকবে ট্রাম্পের নেতৃত্বে ‘বোর্ড অব পিস বা শান্তি পরিষদ।’

সবচেয়ে বড় কথা, এই চুক্তিতে কঠিন রাজনৈতিক বিষয়গুলো ভবিষ্যতের কোনো এক অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঠেলে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান দখল প্রসঙ্গে এই চুক্তি একেবারেই নীরব। ফলে ইসরায়েলের জন্য যে কোনো সময় ফিলিস্তিনিরা শর্ত মানেনি অভিযোগ তুলে আবার দমননীতি জোরদার করা বা সহিংসতা শুরু করার সুযোগ সব সময় খোলা থাকবে।

তাই এই পরিকল্পনা সফল হবে বলে বিশ্বাস করতে হলে ধরে নিতে হবে যে, বহির্বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ বজায় রাখবে, যাতে তারা এই চুক্তি রক্ষা করে এবং ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ন্যায়ভিত্তিক ও স্থায়ী শান্তির পথে এগোয়। ট্রাম্প হয়তো এখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর টালবাহানা দেখে ক্লান্ত হয়ে তাঁকে এই অস্পষ্ট চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য করেছেন। সেটাই প্রমাণ করে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট চাইলে ইসরায়েলের ওপর কতটা প্রভাব খাটাতে পারেন।

কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই যে নেতানিয়াহু, তাঁর কট্টর ডানপন্থী সমর্থক কিংবা ইসরায়েলি সমাজ সত্যিকারের দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান বা এক রাষ্ট্রীয় কনফেডারেশনের কোনো রূপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। এমনকি তারা যদি নিশ্চিতও হন যে হামাস এবং অন্যান্য সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো পুরোপুরি প্রান্তিক হয়ে গেছে; তবুও হয়তো তারা মানবে না। ট্রাম্পের কুখ্যাত স্বল্প মনোযোগ, খামখেয়ালি ব্যক্তিত্ব এবং খুঁটিনাটি বিষয়ে অনাগ্রহের কথা বিবেচনা করলে সত্যিই কি কেউ বিশ্বাস করে যে তিনি এই উদ্যোগে দীর্ঘ মেয়াদে তাঁর মনোযোগ বা অনুসরণ বজায় রাখবেন?

সমস্যাটা কেবল ট্রাম্প নন। অতীতে বাইরের শক্তিগুলো প্রায়ই যুদ্ধে লিপ্ত পক্ষগুলোকে সাময়িকভাবে লড়াই বন্ধে রাজি করিয়েছে—যেমন ১৯৫৬,১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন করেছিল, কিংবা যুক্তরাষ্ট্র পরে বহুবার করেছে। কিন্তু তারা কখনোই যথেষ্ট সময়, মনোযোগ, রাজনৈতিক পুঁজি বা নিজেদের পূর্ণ প্রভাব ব্যবহার করে একটি ন্যায়সংগত ও টেকসই রাজনৈতিক সমাধানে আগ্রহ দেখায়নি। এ কারণেই অসলো চুক্তি, ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলন, ২০০৭ সালের আনাপোলিস সম্মেলন, ব্যর্থ মধ্যপ্রাচ্য কোয়ার্টেট উদ্যোগ এবং অন্যান্য বহুল প্রচারিত শান্তি উদ্যোগগুলো সবই ব্যর্থ হয়েছে।

এই অবস্থায় যদি স্থায়ী মার্কিন চাপই এই অঞ্চলে শান্তির পূর্বশর্ত হয়, তাহলে পরের প্রশ্নটি হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো—যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সম্পর্ক কি এমনভাবে বদলে যাচ্ছে, যা ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অবস্থান যাই হোক না কেন, শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে?

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলায় হামাস আন্তর্জাতিকভাবে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের গণহত্যামূলক প্রতিক্রিয়াও দেশটির ভাবমূর্তিতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে—প্রতীকী পদক্ষেপ হলেও এটি মনোভাবের পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। ইসরায়েলের আরব বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাগুলোও এখন স্থগিত।

যুক্তরাষ্ট্রে জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে নাটকীয় পরিবর্তন। আগের তুলনায় এখন বেশি সংখ্যক আমেরিকান ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করছে। ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গণহত্যার সমতুল্য, আর মাত্র ২২ শতাংশ বলেন, সেই পদক্ষেপ ন্যায্য। ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন সবচেয়ে বেশি কমেছে ডেমোক্র্যাট ও স্বতন্ত্র ভোটারদের মধ্যে। তবে বিশিষ্ট রক্ষণশীল নেতারাও—যেমন স্টিভ ব্যানন, টাকার কার্লসন এবং কংগ্রেস সদস্য মার্জোরি টেলর গ্রিন—ইসরায়েল নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ডেমোক্র্যাটরা বেশি উদ্বিগ্ন মানবাধিকার ইস্যুতে, আর রক্ষণশীল সমালোচকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্তভাবে এক ক্রমবর্ধমানহারে অবাধ্য হতে থাকা ইসরায়েলকে সমর্থন করা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বিশেষ সম্পর্কের প্রত্যক্ষ মূল্য বহু দিন ধরেই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার সবচেয়ে বড় বিদেশি গ্রহীতা ইসরায়েল। দেশটির তথাকথিত ‘গুণগত সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব’ বজায় রাখার আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকারও করেছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ ইসরায়েল একটি সমৃদ্ধ দেশ—মাথাপিছু আয়ে বিশ্বের ১৬ তম স্থানে দেশটি এবং তাদের রয়েছে বিপুল পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার। সাধারণত দেশটি প্রতিবছর প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা পায়। তবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার, যা সবটাই গিয়েছে মার্কিন করদাতাদের পকেট থেকে।

এই নিঃশর্ত সহায়তাই যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ দেশে অজনপ্রিয় করে তুলেছে। যদিও সেসব দেশের শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য অস্ত্র, বিনিয়োগ ও বাজার প্রবেশাধিকারের আশায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ইসরায়েলের প্রতি এই অন্ধ সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সফট পাওয়ার’ বা নৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করে দেয়। কারণ, এটি ওয়াশিংটনের মানবাধিকার রক্ষার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নৈতিকভাবে রাশিয়া বা চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির চেয়ে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে। ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে এই ভণ্ডামি হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ তাদের অগ্রাধিকারে এসব নৈতিক আদর্শের স্থান কম, তবে এটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের উদারনৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এই বিশেষ সম্পর্কের আরেকটি দিক হলো—এক কোটি মানুষেরও কম জনসংখ্যার একটি ছোট দেশ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের রাজনৈতিক জীবনে অযথা বিপুল প্রভাব বিস্তার করছে। ভাবুন, ইসরায়েল নামের এই ছোট দেশটিকে নিয়ে মার্কিন গণমাধ্যমে যত খবর, বিশ্লেষণ, আলোচনা হয়, তার তুলনায় কত কম জায়গা পায় বড় ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো—যেমন ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া বা ব্রাজিল। ইসরায়েলের সমান জনসংখ্যা ও জিডিপির দেশ অস্ট্রিয়া, যেখানে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা সদর দপ্তর স্থাপন করেছে—তবু সে দেশের খবর মার্কিনদের কানে পৌঁছায় কদাচিৎ। আবার দেখুন, কত থিংকট্যাংক ও লবিং গ্রুপ শুধু এই একটি দেশকে ঘিরে কাজ করছে কিংবা মার্কিন রাজনীতিকেরা ইসরায়েলের বিষয়ে কতটা সময় ব্যয় করেন।

এমনকি এই ছোট দেশটিকে ঘিরে থাকা বিষয়গুলো প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও প্রভাব ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সাম্প্রতিক হামলার পেছনে নানা কারণ থাকলেও, গাজায় গণহত্যা ও তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রতিবাদে (যেখানে অনেক ইহুদি শিক্ষার্থীও অংশ নিয়েছেন) ছাত্রদের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত ‘ইহুদিবিদ্বেষের’ অভিযোগ এই আক্রমণকে আরও তীব্র করেছে। একাডেমিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর এই আঘাতের পেছনে ইসরায়েলকে সমালোচনা থেকে রক্ষা করার একতরফা ইচ্ছাই একমাত্র কারণ নয়, তবে সেটিও নিঃসন্দেহে একটি বড় উপাদান।

শেষ পর্যন্ত, ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের যে পরিমাণ সময় ও মনোযোগ ব্যয় করতে হয়, সেটিও উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সালে জিমি কার্টার নিজে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় দিয়েছিলেন ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির আলোচনায়। বিল ক্লিনটনও একইভাবে চেষ্টা করেছিলেন। এর বাইরেও তাঁরা এই বিষয়ে অসংখ্য ঘণ্টা ব্যয় করেছেন। জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা এবং জো বাইডেন—তিনজনই ইসরায়েল-সংক্রান্ত বিষয়েই দিন বা সপ্তাহ পার করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন চার বছরে ১৬ বার ইসরায়েল সফর করেছেন, অথচ পুরো সময়ে আফ্রিকা মহাদেশে গেছেন মাত্র চারবার। এমনকি ট্রাম্পও চাইলেও ইসরায়েল নীতি থেকে পুরোপুরি নিজেকে দূরে রাখতে বা তা অধস্তনদের হাতে ছেড়ে দিতে পারেননি। প্রেসিডেন্ট, তাঁর উপদেষ্টা ও শীর্ষ কর্মকর্তারা এই একটি দেশকে ঘিরে যত সময় ব্যয় করেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অন্য সমস্যাগুলোয় ব্যয় করা সম্ভব হতো।

এ কারণেই আমি ও আরও অনেকে বারবার আহ্বান জানিয়েছি—যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইসরায়েলের সঙ্গে একটি ‘স্বাভাবিক সম্পর্ক’ গড়ে তোলা। সেই সম্পর্ক হবে ইসরায়েলের আকার, কৌশলগত গুরুত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি স্বাভাবিক সম্পর্কে ওয়াশিংটন আর ভান করবে না যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। ইসরায়েল এমন কিছু করলে যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাম্য, তাহলে তারা আমেরিকার সমর্থন পাবে। কিন্তু যদি এমন কিছু করে যা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের বিরুদ্ধে যায়—যেমন দখলকৃত ভূখণ্ডে নতুন বসতি স্থাপন—তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বিরোধিতার মুখে পড়বে।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ইসরায়েল ‘স্বাভাবিক দেশ’ নয়, তাই স্বাভাবিক সম্পর্কের ধারণাটাই অর্থহীন। কারণ হিসেবে তারা বলবেন, ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের ঐতিহাসিক পটভূমি, খ্রিষ্টানদের দীর্ঘ ও করুণ ইহুদিবিদ্বেষ, হলোকাস্টের উত্তরাধিকার আর মধ্যপ্রাচ্যের জটিল সংঘাতপূর্ণ বাস্তবতা। হয়তো তাই। কিন্তু ২০২৫ সালে ইসরায়েল যেভাবে ‘অস্বাভাবিক’, সেটাই আসলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অন্ধ সমর্থন কমানোর কারণ, বাড়ানোর নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইয়ান লাস্টিক সম্প্রতি বলেছেন, ইসরায়েল এখন ক্রমশ ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক এজেকিয়েল দ্ররের বর্ণনা অনুযায়ী একটি ‘পাগল রাষ্ট্রে’ পরিণত হচ্ছে। দ্রর এমন রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছেন। এমন রাষ্ট্র—১) আগ্রাসী ও ক্ষতিকর লক্ষ্য অনুসরণ করে,২) সেই লক্ষ্য অর্জনে চরম আদর্শিক অন্ধত্ব দেখায়,৩) নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের গর্ব করে, অথচ অনৈতিক কাজ করতে পিছপা হয় না,৪) লক্ষ্য অর্জনে যৌক্তিক কৌশল বেছে নিতে পারে এবং ৫) তা বাস্তবায়নের সামর্থ্যও রাখে।

লাস্টিকের মতে, ইসরায়েলের এই বিপজ্জনক গতিপথের একটি প্রধান কারণ হলো মার্কিন প্রশাসনগুলোর কাছ থেকে প্রায় নিঃশর্ত সমর্থন পাওয়া—যা এসেছে ‘ইসরায়েল লবির অতিমাত্রায় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ক্ষমতা’ থেকে। এই অবস্থান কি ‘ইসরায়েলবিরোধী?’ মোটেও নয়। বরং নিঃশর্ত সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন ক্ষতিকর, ইসরায়েলের জন্য তেমনই ধ্বংসাত্মক। আজ ইসরায়েল আন্তর্জাতিক পরিসরে সমর্থন হারাচ্ছে, অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত হচ্ছে, আরও বেশি করে উগ্র ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে এবং দক্ষ, শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম নাগরিকেরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

একটি ‘ইতিবাচক স্বাভাবিক’ নীতিই দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল—দুই দেশের জন্য ভালো হবে। যদিও এতে এআইপ্যাক, জায়নিস্ট অর্গানাইজেশন অব আমেরিকা, ক্রিশ্চিয়ানস ইউনাইটেড ফর ইসরায়েল এবং সেই সব সংগঠনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে—যারা বছরের পর বছর ‘বিশেষ সম্পর্ক’ টিকিয়ে রেখেছে, ইসরায়েলকে আজকের দুরবস্থায় নিয়ে এসেছে, এবং ফিলিস্তিনের লাখ লাখ মানুষের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, তা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছে। সংক্ষেপে, যদি কেউ স্থায়ী শান্তি চায়—তাহলে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ‘আরও স্বাভাবিক’ হতে হবে।

লেখক: স্টিফেন মার্টিন ওয়াল্ট, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

শাহেনশাহ-ই-পাকিস্তান: আসিম মুনিরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি তাসের ঘর

যে ইমরান খানকে আমি চিনতাম—শশী থারুরের স্মৃতিকথায় আশঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলার উত্তেজনায় রাশিয়া ও চীন কেন নীরব

দুবাইয়ে তেজস দুর্ঘটনা: সামনে আসছে ভারতের যুদ্ধবিমান কর্মসূচির পুরোনো দুর্বলতা

হাসিনার ভাগ্যে কী আছে

ইমরানকে সরানোর খেসারত: পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নীরব অভ্যুত্থান, দেশ শাসনের নয়া মডেল