হোম > পথের কথা

৫ টাকার দুঃখ

সাহস মোস্তাফিজ

‘একটা চকলেট বেচি ২ ট্যাকা কইরা। হ্যায় আমার কাছে ১০টা চকলেট চাইল। দাম হইছে বিশ ট্যাকা। হ্যায় আমার লগে মুলামুলি করে। পরথমে দেয় ১০ ট্যাকা। পরে আবার ৫ ট্যাকা দিছে।’ 

কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়েছিলাম টিকিট কাটতে। রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম আমার ভীষণ প্রিয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্ল্যাটফর্মে বসে থাকতেও আমার ক্লান্তি লাগে না। বসে বসে মানুষ দেখি। হরেক রঙের মানুষ। টিকিট কেটেই তাই প্ল্যাটফর্মে ঢুকলাম। ঘড়িতে তখন সকাল ১১টা। তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে তীব্র জ্যাম ঠেলে এসেছি। ভাবলাম প্ল্যাটফর্মে বসে একটু জিরিয়ে নিই। এরই মধ্যে কানে এল চিৎকার চেঁচামেচি। ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের দুঃখ আওড়াচ্ছিল এক চকলেট বিক্রেতা। 

কী নিয়ে চেঁচামেচি, জানার আগ্রহ জন্মাল। ছেলেটির কাছে গেলাম। ওর বয়স দশ কি বারো। জানতে চাইতেই বলতে শুরু করল, ‘আচ্ছা দাদা, ধরেন, আমনে আপনার হোন্ডাটা কিনতে গেছেন। হোন্ডার দাম ১ লাখ ট্যাকা। এখন আমনে ৫০ হাজার ট্যাকা দিলে কি দোকানদারে নিব? আমার দারেও (কাছেও) তো আমার চকলেটটা এমনই। আমনের কাছে ১ লাখ ট্যাকা যা, আমার দারে এই ২ টাকাই তা। আম্নের হোন্ডার চাইয়াও এইটা বেশি আমার কাছে। এইটা দিয়াই আমার সংসার চলে। কয় ট্যাকা লাভ করি আমি?’ 

ছেলেটি বুদ্ধিমান। আমার হাতে রাখা হেলমেট দেখে সেটা ধরেই উদাহরণটি টেনেছে। বুঝলাম, ঝামেলাটা ওই ৫ টাকা নিয়েই। ৫ টাকা আমাদের অনেকের কাছে সামান্য হলেও অল্প বয়সে জীবনযুদ্ধে নামা এই ছেলের কাছে এর দাম অনেক। জানতে পারলাম, ছেলেটির নাম জসীম। থাকে খিলগাঁও। কত আয় হয় জানতে চাইলাম। বলল, ‘সারা দিন বেইচা দেড় শ ট্যাকা থাকে। এর মধ্যে যদি ৫ ট্যাকা কম দেয়, আমার থাকে কী। এইখানে আইতে আমার গাড়ি ভাড়া লাগে না? আমার খাওয়া লাগে না? আমার বাড়িতে ট্যাকা দেওয়া আগে না?’ 

‘এইটা দিয়াই আমি খাই, মায়েরে খাওয়াই, গাড়ি ভাড়া দেই, বাজার খরচ করি। আমার কাছে ৫ ট্যাকা তো অনেক কিছু।’ 

অবাক হলাম। সারা দিনে দেড় শ টাকা! ‘এই প্যাকেটে ধরেন আড়াই শ চকলেট থাহে। ২০০ টাকা কিনা। আমি ২ ট্যাকা কইরা বেচি। কত হইলো? ৪০০ টাকা। এর পর আমার গাড়ি ভাড়া আছে না? আমার খাইতে হয় না? এইডা দিয়াই তো আমার সব। আমার সব চলে এইডা দিয়া। এমনই আমার জীবন।’ 

জীবন নিয়ে এত নিখুঁত হিসাব আমাকে মুগ্ধ করল। হয়তো অনেকবার এমন ঠকেই শিখেছে ও। এখন প্রতিবাদ করা শিখেছে। তবুও সমাধান মিলছে না এখনো। আজ ৫ টাকা কম দিয়ে চলেই গেছে ওই ক্রেতা। আগেও এমন হয়েছে অনেকবার। 

‘পড়ালেখা করো না?’ -জানতে চাইলাম। ‘পড়াশোনা আমি করছি মাদ্রাসায়। নিজের বেতন খরচা নিজেই চালাইছিলাম। সকাল বেলা পড়তাম, এর পর সারা দিন কাজ করতাম। তখন অনেকেই কইত, ট্যাকা-পয়সার মুখ দেখসোস তো, এহন তো আর পড়বি না। কিন্তু হ্যারা তো এইটা বুঝল না, এই ট্যাকাটা দিয়াই আমার জীবন চলে। আম্মায় বাসা-বাড়িত কাম কইরা ঘর ভাড়া দেয়, আমি বাজার সদাই করি। আমি পড়ি কেমনে?’ 

‘বাবা কই?’ প্রশ্নটা করতেই বুঝলাম, ঠিক হয়নি। মন খারাপ হয়ে গেল জসীমের। ওর যুদ্ধের কারণটাই যে ওটা। বাবা ছিলেন ড্রাইভার। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২০১৭ সালে। মাত্র সাত কি আট বছর বয়সেই অন্ন জোগাড়ে রাস্তায় নেমে পড়তে হয় জসীমকে। 

‘এইটা তো আমার কষ্টের ট্যাহা। আমি তো আর দুই নম্বরি কইরা নিতাসি না। আপনের কাছে ট্যাকা না থাকলে তিনটা নেন,২টা ফেরত দিয়া দেন। ৫ টাকা কম দিয়া হ্যায় কী জিতব?’ আবারও ওই ৫ টাকার দুঃখ গাইতে থাকল জসীম। ‘করোনার এই লকডাউনে তো কতগুলো দিন না খাইয়াই আছিলাম। চকলেট বেচতেও পারি নাই।’ দুঃখ করে জসীম। 

আমার কী যেন মনে হতেই ওর বয়ামে থাকা বাকি চকলেটগুলো কিনে নিলাম। ও গুনে বলল ৮০টা আছে। দাম আসে ১৬০ টাকা। ২০০ টাকার নোট দিতেই গুনে গুনে ৪০ টাকা ফেরত দিল। কর্মে বাঁচা জসীমকে চকলেটগুলো ফেরত দিতে পারতাম। কিন্তু হুট করে মনে হলো, সেটা করে ওর শ্রমকে হয়তো অবহেলা করা হবে। 

আশপাশে জসীমের অনেক বন্ধু ততক্ষণে জমে গেছে। ‘চকলেট খাবা?’ বলতেই নাচতে লাগল ওরা। ভাগ করে দিলাম চকলেটগুলো। জসীম বলল, ‘আপনিও একটা খান। সব দিয়া দিয়েন না।’ 

মুহূর্তের এই আনন্দ ভাগ করে নিয়ে চললাম নিজ গন্তব্যে। জসীমের প্রতিবাদের ভাষা কানে বাজছিল, চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছিল—‘বাপ নাই। আমার এই কাজটাই সম্বল। অনেক দোকানে এই চকলেটের কোনো দামই নাই। অনেক মাইনসের কাছেও নাই। কিন্তু আমার কাছে এইটাই জীবন।’ 

চুম্বকে চলছে শেফালীর জীবিকা

লাগামহীন দ্রব্যমূল্য: কেমন আছেন খেটে খাওয়া মানুষ

দার্জিলিংয়ের সেই গোমড়ামুখো চালক

‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরেমেঘ দেখলেই ডরায়’

 ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম, তুমি চলে গেলে’

বরই বেচে ভাত জোটে না দেলোয়ারের

দুর্গম পাহাড়ি পথে ভরসা বাবুল বড়ুয়া

টিয়া পাখির বাচ্চার প্রাণ বাঁচানো লিয়নকে বাঁচাবে কে

দুই কিডনিই বিকল, মেয়েকে বাঁচাতে প্রবাসী কর্মী মা এখন অটোরিকশা চালক

সত্তরোর্ধ্ব হাসেমের কাঁধে দিনভর আইসক্রিমের বাক্স, তবুও বুড়ো-বুড়ির সংসারে টানাটানি