সকাল সাড়ে ৮টায় মোহাম্মদপুরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের সামনে বসা বাজারটায় গিয়েছিলাম। ভরা হাট যেন। সমানতালে বিকিকিনি চলছে। কত রকম মাছ! কত রকম ফল। কত রকম সবজি!
এক বিক্রেতা হেঁকে যাচ্ছিল, ‘এক শ টাকায় আড়াই কেজি। হিমসাগর। হিমসাগর!’
একটা ভ্যানে অনেকগুলো কাঁঠাল। সুবাসে মঁ মঁ করছে আশপাশ। কাঁঠালের দামও চড়া নয়। ৮০ টাকায় মাঝারি আকারের একটা কাঁঠাল কিনে ফিরছিলেন তৃপ্ত একজন।
এত কম টাকায় আস্ত একটা কাঁঠাল পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
সেই কাঁঠালের গল্পই আসবে আরেকটু পর। যখন আরেকটু এগিয়ে আমরা বিজয় সরণি পার হয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে বনশ্রী আসব।
সে সময় নাক–কান–গলা ইনস্টিটিউট পার হয়ে পথে পড়বে হাতিরঝিলে ঢোকার মোড়। কাঁঠাল আর আম নিয়ে যিনি বসে আছেন, তাঁর দিকে এগোলে বিক্রি–বাট্টার আশায় তিনি তাকিয়ে থাকেন।
কথা বলি আমরা।
‘আপনার নাম কী?’
‘জাফর আমার নাম।’
‘শুধু জাফর?’
‘শুধুই জাফর মনে করেন।’
‘পরিবারে আর কে আছে?’
‘বর্তমানে আছি তিনজন। মেয়ে বিয়ে দিসি। স্বামী–স্ত্রী আর এক ছেলে।’
‘ছেলের বয়স?’
‘সতেরো বছর। লেখাপড়া করে। এই কমিটি সেন্টারে…’
‘কমিউনিটি সেন্টার স্কুলে?’
‘হ্যাঁ। পড়ে।’
‘কেমন চলছে ব্যবসা?’
‘খুব খারাপ। করোনার আগে দিনে দশ হাজার টাকার ব্যবসা হতো, এখন তিন হাজারো হয় না।’
‘সংসার চলে কী করে?’
‘গরিবের একটাই উপায় আছে। মরণ।’ —এই কথা বলে ওঠেন পাশেই রাস্তায় চেয়ার রেখে, গাছে আয়না ঝুলিয়ে রাখা এক নরসুন্দর। কথায় বোঝা যায়, দুজনের মধ্যে খুব ভাব। কিন্তু জাফর তা স্বীকার করেন না। বরং বলেন, ‘না। মরব কেন? একবেলা তো খাই তিনবেলার মধ্যে। তবুও তো খাই! করোনা তো এক সময় চইল্লা যাবে। আল্লাহ খাওয়াবে বলে বসে থাকলে তো হবে না। সে জন্য তো চেষ্টা করতে হবে। কেউ তো মুখে তুইলে খাওয়াবে না।’
‘কয়টা কাঁঠাল বিক্রি হয়েছে আজ?’
‘এহনতরি একটাও বেচি নাই।’
‘আম?’
‘আম বেচছি এক কেজি ভাইয়া।’
‘কাঁঠালের দাম এবার কি একটু কম?’
‘কম ঠিক আছে ভাইয়া, কিন্তু ক্যারিং কস্ট খাইয়া লায়। আনার জন্য ২৫ টাকা খরচা আছে একটা কাঁঠালের। ময়মনসিং (ময়মনসিংহ) থেকে আনতে।’
‘কয়টা আনতে ২৫ টাকা?’
‘এক পিস। তিরিশ টাকা দিয়ে যদি কিনি, ঢাকা আনতে ষাইট টাকা পড়ে।’
‘কম দামেও বিক্রি করতে হচ্ছে, আপনার খরচটাও বেশি হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ?’
‘আপনার কী মনে হয়? করোনা কেটে যাবে?’
‘হ্যাঁ, কেটে যাবে। সে পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।’ এ কথা বলে জাফর মিয়া নিজের কাঁঠালগুলোর দিকে তাকান। জাতীয় ফলগুলোও তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে কিনা, সেটা বুঝতে পারবে জাদুবাস্তবতায় যারা আমাদের জড়িয়ে থাকেন, তাঁরা।
আপাতত বলা যায়, লকডাউনের প্রথম দিনে যেখানেই গেছি, দেখেছি মানুষের ভিড়। গাড়ির সারি। সরকারি–বেসরকারি অফিস খোলা। নির্দেশ ছিল, প্রয়োজন না থাকলে যেন কেউ বাড়ি থেকে বের না হয়।
জাফর মিয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ঢাকাজুড়ে সব মানুষই কি প্রয়োজনে বেরিয়েছে রাস্তায়—সে কথা কে জানবে?