হাসিনার উত্থান-পতন
১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সভাপতি হওয়ার সময় ভারতে নির্বাসনে ছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গতকাল সোমবার তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায়ের সময়ও তিনি ভারতে। কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে অসংখ্য প্রাণ কেড়ে নেওয়ার নির্দেশনার সাজা পেলেন তিনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তিনি সেখানেই আছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার সময় তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। সেখানে থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ১২তম সম্মেলনে তাঁকে দলীয় সভাপতি করা হয়। ওই বছরের ১৭ মে তিনি দেশে ফেরেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল বর্জন করলেও অংশ নেয় আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন হাসিনা।
গণ-আন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে দেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। আবারও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-বইঠার আন্দোলনে ব্যাপক সমালোচনা হয় দলটির। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্বে আসার পর ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মামলা হয়েছিল। ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তি পান।
২০০৯ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ওই সরকার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রচলন শুরু করে। একপেশে ওই নির্বাচনে ১৫৩ জন এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। নানান আলোচনা ও হাসিনার প্রতিশ্রুতির কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল; যা রাতের ভোট নামে পরিচিতি পায়।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-জামায়াতসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এই নির্বাচনকে ‘আমি’ ও ‘ডামি’ নির্বাচন নামে অবহিত করা হয়। ওই বছরের জুনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। জুলাইয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) নেতা-কর্মীদের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বর্বর হামলা চালায়। ৩৬ দিনের আন্দোলনে এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়। গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।