শ্রদ্ধাঞ্জলি
কমরেড দাউদ হোসেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। যিনি বিগত পাঁচ দশকের অধিক সময় ধরে নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন। তাঁর নিরলস লড়াইয়ের ইতি টেনে ২১ নভেম্বর বেলা ১১টায় তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
কমরেড দাউদ হোসেনের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল বিংশ শতকের ষাটের দশকের শুরুর দিকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে হাতেখড়ির মাধ্যমে। তখন থেকেই তাঁর ভাবনাজুড়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিষয়টি পাকাপোক্তভাবে গেঁথে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নকালে তিনি ১৯৬৩-৬৪ সালে রবীন্দ্রচর্চা নিষিদ্ধের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নেন। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার জন্য প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথেও ঝাঁপিয়ে পড়তে তিনি মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন এবং সেই লক্ষ্যে সংগঠন বিস্তারের কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের নিবর্তনমূলক শাসন থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সমমনাদের নিয়ে ‘পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তি সংস্থা’ গঠন করেন।
দাউদ হোসেনের নেতৃত্বে যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা গ্রামে পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তি সংস্থার (জামুস) গোপন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান সামরিক আইনে জামুস সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। গ্রেপ্তার এড়িয়ে দাউদ হোসেন চলে যান গুপ্ত রাজনৈতিক জীবনে, যা ব্যাহত করে তাঁর ছাত্রজীবনকে। মাথার ওপর ঝুলতে থাকে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের হুলিয়া।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন মস্কো-পিকিং লাইনে বিভাজিত হওয়ার পরপর ‘শ্রমিক মুক্তি সংঘ’ সংগঠনটি গড়ে ওঠে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সমাজবিপ্লবের পথে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে তিনি শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘে যোগদান করেন এবং কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে লিপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সালখ্যাত ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে জামুস সদস্যরা এবং কর্মী সংঘ দাউদ হোসেনের নেতৃত্বে সক্রিয় অংশ নেন এবং ৬ দফা ও ১১ দফার সমর্থনে কৃষক সমিতির মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় জনমত গঠন করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শতধাবিভক্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রিয়াশীল নানামুখী দল-উপদলের সমন্বয়ে কলকাতায় বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গড়ে তুলতে শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং সমন্বয় কমিটির অন্যতম সংগঠক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর শ্রমিক-কৃষক কর্মী সংঘ ‘বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংঘের প্রয়োজনে তিনি নিজ গ্রামে বসবাস শুরু করেন এবং কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে অবলম্বন করেন, যাতে নিয়োজিত থাকেন দীর্ঘ ১৪ বছর। এ সময় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন একটি হাইস্কুল। এ ছাড়া অত্র এলাকায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনায় পালন করেন মুখ্য ভূমিকা।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে এক ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় কর্মী সংঘ ও কৃষক সমিতির কয়েক ডজন নেতা-কর্মীসহ গ্রেপ্তার হন। আদালতের বিচারে তাঁরা সবাই নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং ১৯৭৭ সালে মুক্তি পান।
১৯৮০ সালে যশোর থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক শনিবার’ পত্রিকা, যা দুই বছর টিকে ছিল।
’৮৪ সালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রিয়াশীল পার্টিগুলোর তাত্ত্বিক দেউলিয়াত্ব তুলে ধরতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে গভীরভাবে আস্থাশীল থেকে সূচনা করেন লাগাতার ধারাবাহিক মতাদর্শিক সংগ্রাম। এ সংগ্রামকে কার্যকরের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ঢাকায় চলে আসেন।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন মস্কো ও পিকিং লাইনে বিভাজিত হয়, তখন থেকেই তিনি ছিলেন এই ঘোরতর বিরোধী। এই বিভক্তির বিলোপবাদী পেটিবুর্জোয়া চরিত্র উন্মোচনে তত্ত্বগত সংগ্রামের গুরুত্ব তুলে ধরতে দেশীয় প্রাসঙ্গিকতায় লেনিনের অর্থশাস্ত্রীয় গ্রন্থাদির অনুবাদকর্ম শুরু করেন এবং লেনিনের ‘বাজার প্রসঙ্গ’, ‘নারোদবাদের অর্থনৈতিক মর্মবস্তু’, ‘অর্থনৈতিক রোমান্টিকতাবাদ’-এর বঙ্গানুবাদ সংঘ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৮৮-৮৯ সালে উল্লিখিত লেনিনের তিনটি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদের মাধ্যমে বঙ্গীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে সক্রিয় পার্টিগুলোর মতাদর্শিক দেউলিয়াত্বের কার্যকরণ বিশ্লেষণ করে প্রতিটি গ্রন্থের ভূমিকায় বিদ্যমান পার্টিগুলোর শ্রেণি অবস্থান ও বাস্তবতা তুলে ধরেন।
বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল-উপদল থেকে বেরিয়ে আসা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে নিয়মিত পাঠচক্র সংগঠিত করে। এসব পাঠচক্রের মধ্যে ছিল ‘মার্ক্সবাদ চর্চাকেন্দ্র’, ‘মার্ক্সবাদ অনুশীলন সমিতি’ ও ‘পর্যালোচনা পরিষদ’। দাউদ হোসেন অনূদিত ও প্রকাশিত লেনিনের গ্রন্থসমূহ পাঠ করে নিয়মিত পাঠচক্রে অংশগ্রহণকারী কর্মীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কমিউনিস্ট কর্মী সংঘের অংশগ্রহণে পাঠচক্রগুলোর সমন্বয়ে গড়ে তোলেন যৌথ পাঠচক্র। পরবর্তী সময়ে যৌথ পাঠচক্রগুলো সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৮৯ সালের ১ ডিসেম্বর যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কর্মী সংঘে যোগদান করে।
১৯৯০-৯১ সালের কালপর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সংকটকালে কমিউনিস্ট কর্মী সংঘের কার্যকলাপ সীমিত গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়লে দাউদ হোসেন ‘সাপ্তাহিক রোববার’ পত্রিকায় সিনিয়র সহসম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে লেখালেখির কাজ অব্যাহত রাখেন। তাঁর অনূদিত ও সম্পাদিত আরও কয়েকটি বই হলো ‘আমারে কবর দিও হাঁটুভাঙার বাঁকে’, লেনিনের ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’, ফজলুল কাদের কাদেরী সংকলিত ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’-এর বঙ্গানুবাদ। গুয়াতেমালার নোবেল বিজয়ী রেড ইন্ডিয়ান নারীনেত্রী রিগোবার্তা মেনচু রচিত আত্মজীবনী ‘আমি রিগোবার্তা মেনচু’ এবং ‘সীমান্ত পেরিয়ে’ গ্রন্থ দুটি।
এ ছাড়া তাঁর প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ ‘বিংশ শতাব্দীর শেষবাঁকের দ্বান্দ্বিকতা’। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় আন্দ্রেই আনিকিন রচিত মস্কোর প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘অর্থশাস্ত্র বিকাশের ধারা’ গ্রন্থটি। এরপর তিনি প্রকাশ করেন কৌটিল্য রচিত ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থটি। কার্ল মার্ক্স রচিত ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর ইংরেজি তিন খণ্ডের বঙ্গানুবাদ তাঁর হাতেই সম্পাদিত হয়ে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে পাঁচটি পৃথক খণ্ডে।
২০০১ সালে বঙ্গীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রাধান্যশীল পেটিবুর্জোয়া ধারাগুলোর সমালোচনা করে লেখেন ‘মার্ক্সবাদের বঙ্গীয় স্বরূপ’ গ্রন্থটি।
অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী আজীবন সংগ্রামী কমরেড দাউদ হোসেন তত্ত্বগত সংগ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করে পেশা হিসেবে লেখনী ও প্রকাশনাকে বেছে নিয়েছিলেন। এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই মহতী কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। কমরেড দাউদ হোসেন তাঁর সৃজনশীল কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক