হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ বাঁচবে কীভাবে

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক

এআই যুগে টিকে থাকার মূল শক্তি হলো মানুষের চিন্তা, সৃজনশীলতা, সহানুভূতি এবং বিশ্লেষণশক্তি। ছবি: পেক্সেলস

আমরা এখন সেই পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে, যেখানে এআই শুধু উন্নয়ন নয়, মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নতুনভাবে লিখে দেওয়ার শক্তি ধারণ করে। আজকের বাস্তবতা হলো, বিশ্বের অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই কর্মী ছাঁটাই করছে এবং সেই কাজগুলো দ্রুত এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। এই পরিবর্তন কাউকে অপেক্ষা করে না। তাই প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি এই রূপান্তরকে ভয় পাবে, নাকি বুঝেশুনে নতুন পথে হাঁটবে।

নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বে এআই সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করছে রুটিনভিত্তিক, পুনরাবৃত্তিমূলক এবং ডেটানির্ভর কাজগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে গত তিন বছরে যে চাকরিগুলো সবচেয়ে বেশি হারিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে ডেটা এন্ট্রি, কাস্টমার কেয়ার, বেসিক কোডিং, কনটেন্ট রাইটিং, প্রশাসনিক এবং গ্রাফিকসের প্রাথমিক স্তরের কাজ। অভিজ্ঞতা দেখায় যে নিয়ম মেনে চলা এবং পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ মেশিন মানুষের চেয়ে দ্রুত, সস্তা এবং অনেক কম ভুলের মাধ্যমে করতে পারে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) ফিউচার অব জবস রিপোর্ট ২০২৫-এ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৯২ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে, তবে ১৭০ মিলিয়ন নতুন চাকরি সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ চাকরির সংখ্যা একই থাকবে, তবে ধরন বদলে যাবে। একইভাবে ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (২০১৭) জানিয়েছে, আগামী দশকে ৪০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন কর্মীকে নতুন দক্ষতা অর্জন করে পুনরায় নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। এই ডেটাগুলো প্রমাণ করে যে পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের কোনো ধারণা নয়, এটি এখনই ঘটছে। এখানেই বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। আমার পর্যবেক্ষণে বিশ্বে এআই সবচেয়ে দ্রুত প্রতিস্থাপন করছে ডেটা এন্ট্রি, কলসেন্টার, টিকিটিং, ব্যাংক টেলার, সাধারণ অ্যাকাউন্টিং, লিগ্যাল রিসার্চ, সাধারণ কনটেন্ট তৈরি, ক্যাশিয়ার, প্রাথমিক গ্রাফিক ডিজাইন এবং পণ্যের বর্ণনা লেখার কাজ। যেহেতু বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশ এখনো এসব কাজের ওপর নির্ভরশীল, তাই এখানেই তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।

অন্যদিকে যেসব চাকরি বাড়ছে সেগুলো এআই ব্যবহারের ফলে তৈরি হওয়া নতুন প্রয়োজন এবং মানবকেন্দ্রিক দক্ষতার ওপর দাঁড়ানো। অভিজ্ঞতা বলছে মানবিক যোগাযোগ, বিশ্লেষণ, সৃজনশীলতা এবং কৌশলগত চিন্তার জায়গায় মেশিন মানুষের বিকল্প হতে পারে না। তাই বিশ্বে দ্রুত বাড়ছে এআই ট্রেনিং, সাইবার সিকিউরিটি, ডেটা সায়েন্স, মেশিন লার্নিং ইঞ্জিনিয়ারিং, সফটওয়্যার আর্কিটেকচার, উন্নত ডিজাইন, চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, গবেষণা, শিক্ষা এবং কনসালটিংয়ের মতো পেশা। যদিও এসব দক্ষতা অর্জন কঠিন, কিন্তু একবার দক্ষ হলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে না।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, আমাদের কর্মশক্তির একটি বড় অংশ এখনো ম্যানুয়াল অথবা প্রাথমিক ডিজিটাল কাজে যুক্ত। ফলে এআই প্রথম আঘাত করবে এখানেই। গ্রাফিকসের প্রাথমিক কাজ, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, বেসিক লেখালেখি এবং সাধারণ সফটওয়্যার টেস্টিং। এসব কাজ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্ববাজারে গুরুত্ব হারাবে। অথচ বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ ঠিক এই কাজগুলোর ওপর নির্ভরশীল। তাই প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন ছাড়া প্রতিযোগিতায় থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।

অন্যদিকে সুযোগও কম নয়। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সংখ্যায় বড়, প্রযুক্তি শেখার গতি দ্রুত এবং বৈশ্বিক বাজারে কাজ করার ইচ্ছা প্রবল। ফলে আগামী দশকে আমরা চাইলে ডেটা সায়েন্স, এআই ট্রেনিং, মেশিন লার্নিং অপারেশন, সাইবার সিকিউরিটি এবং ডিজিটাল বিজনেসের বড় সক্ষম শ্রমশক্তি হয়ে উঠতে পারি। কারণ, যত বেশি এআই তৈরি হবে তত বেশি প্রয়োজন হবে দক্ষ মানুষের, যারা এই প্রযুক্তিকে পরিচালনা করবে।

তবে এই রূপান্তর সম্ভব হবে তখনই, যখন বাংলাদেশ শিক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নে সঠিক পথে হাঁটবে। আমার মতে, বাংলাদেশের সামনে পাঁচটি দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, স্কিলভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মুখস্থনির্ভর শিক্ষা নয় বরং বিশ্লেষণধর্মী এবং বাস্তবধর্মী জ্ঞানকে মূল্য দেওয়া হবে।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় পর্যায়ে একটি এআই দক্ষতার রোডম্যাপ প্রয়োজন, যাতে জানা যায় কোন অঞ্চলে কোন দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।

তৃতীয়ত, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই এবং ডেটা ব্যবহার সম্পর্কিত জ্ঞান বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত, কারণ ভবিষ্যতে প্রায় সব চাকরিতেই এআই ব্যবহার করতে হবে।

চতুর্থত, কর্মীদের রিস্কিলিং বা পুনরায় দক্ষতা অর্জনকে নিয়মিত করতে হবে যাতে মাঝবয়সী কর্মীরাও পিছিয়ে না পড়েন।

পঞ্চমত, একটি জাতীয় টেক ইনোভেশন ফান্ড গঠন করতে হবে, যেখানে রাষ্ট্র, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করবে।

এদিকে যাঁরা মনে করেন গ্রাফিকস জানা, কনটেন্ট লেখা বা ওয়েবসাইট তৈরি করা যথেষ্ট এবং তাঁরা কখনো চাকরি হারাবেন না, তাঁদের বুঝতে হবে যে এসব কাজ এআই এখন মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত করে। তাই টিকে থাকতে হলে শুধু কাজ জানা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন কাজের গভীরতা, যুক্তি, কৌশল এবং সৃজনশীলভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা। আগের দিনে যে ডিজাইন বানাতে কয়েক ঘণ্টা লাগত, এখন এআই কয়েক সেকেন্ডে সেটার ১০টি বিকল্প তৈরি করে দিতে পারে। যেসব কনটেন্ট লেখায় আগে দীর্ঘ সময় লাগত, এখন এআই তা মুহূর্তেই তৈরি করতে সক্ষম।

ভবিষ্যতের শ্রমবাজার কঠিন এবং নির্মম। সেখানে থাকবে তিন ধরনের মানুষ।

এক. যারা এআই তৈরি করবে।

দুই. যারা এআই পরিচালনা করবে।

তিন. যারা এআইয়ের কারণে পিছিয়ে পড়বে।

এই পরিস্থিতিতে তরুণদের সামনে বড় প্রশ্ন হলো, কোন দক্ষতা শেখা উচিত। আমার মতে, আগামী দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা, সমস্যা সমাধান, এআই বুঝতে পারা, সাইবার সচেতনতা, সৃজনশীল যোগাযোগ, ডেটা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা, ডিজিটাল ফাইন্যান্স, মানবকেন্দ্রিক নেতৃত্ব, সহানুভূতি এবং বহুবিষয়ক জ্ঞান। এই দক্ষতাগুলো যার আছে তাকে চাকরি খুঁজতে হয় না বরং চাকরিই তার কাছে আসে।

সবশেষে বলা যায়, এআই যুগে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় পাওয়ার বিষয় হলো প্রস্তুতির অভাব। যারা পরিবর্তনকে গ্রহণ করবে এবং নতুন দক্ষতা শেখার সাহস দেখাবে ভবিষ্যৎ তাদের হবে। আর যারা পুরোনো পদ্ধতিতে আটকে থাকবে, তাদের ঝুঁকি বাড়তেই থাকবে। এককথায় এআই যুগে টিকে থাকার মূল শক্তি হলো মানুষের চিন্তা, সৃজনশীলতা, সহানুভূতি এবং বিশ্লেষণশক্তি।

লেখক: ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের নয়া ভূমিকা

রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে