হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

দ্বিমতের অবসান কিংবা ঐকমত্যের সোনার হরিণ

অরুণ কর্মকার

রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকেছে। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ ও পদক্ষেপই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বিমতের অবসান ঘটাতে পারল না। জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে মাঠে নেমেছিল। তারা ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকে গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরির যুগপৎ ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। এরপর তারাই পর্যায়ক্রমে নিজেদের মধ্যে দ্বিমতের এক অমোচনীয় দূরত্ব সৃষ্টি করল। অবশ্য তাদের কারও কারও দাবি অনুযায়ী, এই দূরত্ব ও দ্বিমত সৃষ্টির জন্য দায়ী অন্তর্বর্তী সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মধ্যেও তারা সেই দায়ের উপাদান দেখেছে। ফলে দ্বিমতের অবসান যেমন হলো না, তেমনি ঐকমত্য কমিশন গঠন করে দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ার যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছিল, তা-ও অধরা এক সোনার হরিণ হয়েই রইল।

বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ দেওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরে সেটি গেজেট আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মৌলিক দাবিগুলোর একটি। কিন্তু সেটি যখন আইনানুগভাবে সম্পন্ন হলো, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাকে অভিহিত করল জাতির দুর্ভাগ্য বলে। কারণ, সেটি আইনি ভিত্তি পেয়েছে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে। তাদের দাবি ছিল, আদেশটি জারি করতে হবে প্রধান উপদেষ্টাকে।

কিন্তু তা যে সম্ভব নয়, সেটা তারা বুঝতে চায়নি জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটে। যদিও এখন সে কথা বলে কোনো লাভ নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন থেকে শুরু করে সবই তো হয়েছে দেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে। সুতরাং এনসিপি যা চায় তা পেতে হলে তাদেরকে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে হবে, যা দেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। এটা না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদ, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে গিয়ে সাংবিধানিক সংস্কারের পথেই হাঁটতে হবে। জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ছাড়া এর অন্যথা হওয়ার নয়।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের বিষয়ে এনসিপি অবশ্য আর কোনো মৌলিক প্রশ্ন তোলেনি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের অপর দুই নিয়ামক শক্তি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী তুলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজের সই করা জুলাই জাতীয় সনদ লঙ্ঘন করেছেন। তবে রাতে সে জায়গা থেকে সরে গিয়ে এটাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্বাক্ষর করেছেন, সেটা তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে লঙ্ঘন করেছেন। কীভাবে? প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, জাতির সামনে তা উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে ১৮০ দিনের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করবেন। সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদের আপত্তি এখানেই। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘নোট অব ডিসেন্টের’ মাধ্যমে মীমাংসিত। এটি নতুন করে আরোপ করার কোনো সুযোগ নেই (যা প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে করেছেন)। এ ছাড়া ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ নামে যে বডি, সেটি জাতীয় সংসদের কোনো পর্যায়ে গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার বিষয়ই ছিল না। এটা সম্পূর্ণ নতুন ধারণা। এই পর্যায়ে এসে বিএনপি এই নতুন ধারণাটিকে কীভাবে দেখবে, সেটা অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। সেটি জানা বা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অভিযোগ করেছেন, জনগণের অভিপ্রায় ও গণদাবিকে উপেক্ষা করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। সংবিধান সংস্কার এবং অন্যান্য সংস্কার বিষয়ে যে ৪৮টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতিকে জানাতে হবে। গণভোটে জনগণকে কিসে ‘হ্যাঁ’ আর কিসে ‘না’ বলতে হবে, সেটি নির্বাচনের আগেই জানতে হবে উল্লেখ করে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ভোটারদের গণভোটের বিষয়ে স্টাডি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে গণভোটের বিষয়ে বিস্তারিত ওয়েবসাইটে দিতে হবে। ভোটাররা সেই বিষয়ে জানার পরই গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মতামত দেবেন। কিন্তু একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে একজন ভোটারকে গণভোট দিতে হবে আবার প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনের ভোটও দিতে হবে। সেই সুযোগ না দিয়ে দুটি ভোট একসঙ্গে দেওয়ার ঘোষণায় একটা সংকট তৈরি হলো। এই সংকট নিরসনের জন্যই জামায়াতসহ আটটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেওয়ার যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, তা অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানানো হয়। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বিমত ও অনৈক্যের বিন্দুমাত্রও নিরসন হওয়ার লক্ষণ নেই।

গণভোটে চারটি বিষয়, প্রশ্ন একটি!

এদিকে, গণভোটে প্রশ্ন-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে জনপরিসরে যে আলোচনা চলছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে তারও নিরসন হয়নি। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছেন, চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবেন। চারটি বিষয়ে একটি প্রশ্নে হ্যাঁ কিংবা না বলতে হবে, বিষয়টা ভাবতেই কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। তো কী হবে সেই চারটি বিষয় ও একমাত্র প্রশ্নটি! প্রধান উপদেষ্টা নিম্নোক্তভাবে তা পাঠ করে শুনিয়েছেন।

‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?

ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

এই চারটির প্রথম বিষয়টি ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু অন্য তিনটি বিষয়ের মধ্যে তো ৩০টির বেশি বিষয় রয়েছে! কাজেই এ বিষয়ে হ্যাঁ কিংবা না বলতে হলে বিষয়গুলো ভোটারদের জানতে হবে, যা শিক্ষাগত যোগ্যতার বিবেচনায়ও অসম্ভবই বটে। তা ছাড়া, এগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতিবাচকতা প্রবল। সুতরাং ফলাফল অজ্ঞাত।

স্বস্তিটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারবেন তো

পঞ্চাশ বছরের উচ্চশিক্ষা

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ