দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের জীবন ও জীবিকা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আওয়াজ তুললেও জনমনে সংশয় দূর হচ্ছে না। বরং ফেব্রুয়ারি যতই এগিয়ে আসছে, রাজনৈতিক বিরোধ, অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা ততই বাড়ছে। এর ফলে দেশের শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ ২০২৪ সালের আগস্টে দেশে ‘বৈষম্য থাকবে না, কোটা থাকবে না, চাকরি হবে, কর্মসংস্থান হবে, শিল্প হবে’–এমন অনেক প্রতিশ্রুতির সুরে নতুন আশার আলো দেখেছিলেন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু আজ সেই আশার প্রতিধ্বনি যেন এক নিষ্ঠুর প্রহসনে পরিণত হয়েছে। যে অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রতি অঙ্গীকার করেছিল বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের, বাস্তবে তা যেন উল্টো পথে হাঁটছে। বিশেষত, যাঁরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেই শ্রমিক শ্রেণি আজ কাজ হারিয়ে বেকারত্বের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন।
যে শ্রমিকেরা দিনের পর দিন কারখানার ধোঁয়া ও ঘামের গন্ধে নিজেদের জীবনকে নিঃশেষ করেছেন, সেই শ্রমিকদেরই এখন অন্নসংস্থানের অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে। তাঁরা যাদের জন্য অর্থনীতি সচল, যাঁদের হাতের ছোঁয়ায় ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক বিদেশের বাজারে জায়গা করে নেয়, আজ সেই হাতগুলোই অব্যবহৃত, সেই মুখগুলোই ক্ষুধার্ত।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প দীর্ঘদিন ধরে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান ভিত্তি। প্রায় ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি এই খাতে কাজ করেন এবং আরও ২ কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু গত ১৪ মাসের চিত্র যেন এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দলিল। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ জন শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন। এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়—এগুলো লক্ষাধিক পরিবারের চোখের পানি, অসহায়তার নীরব চিৎকার।
সবচেয়ে বড় আঘাত লেগেছে সাভারে, যেখানে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১২২টি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। বড় কারখানাগুলোর মধ্যে যেমন ছেইন অ্যাপারেলস, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন বা সাফওয়ান আউটারওয়্যার—সবই আজ অতীতের নাম। এরপরের অবস্থান গাজীপুরে, যেখানে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মহীন। বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়া মানে শুধুই অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং হাজার হাজার পরিবারের জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকার নেমে আসা। অবশ্য বেক্সিমকোর কারখানাগুলো আগামী মাসে চালু হচ্ছে। এতে ২৫ হাজার শ্রমিক আবার তাঁদের কাজ ফিরে পাবেন।
কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার এই ঢেউয়ের পেছনে আছে একাধিক কারণ—আন্তর্জাতিক বাজারের মন্দা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বায়ারদের অনিশ্চয়তা এবং স্থানীয় আর্থিক সংকট। বিদেশি ক্রেতারা নির্বাচিত সরকারের স্থিতিশীলতা না দেখে অর্ডার দিতে ভয় পাচ্ছেন, ফলে
ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো টিকতে পারছে না। একদিকে অর্ডারের ঘাটতি, অন্যদিকে শ্রম আইন সংশোধনের মতো বিষয়গুলো মালিক-শ্রমিক উভয় পক্ষের ওপর নতুন চাপ তৈরি করেছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমাচ্ছে বা বন্ধ করে দিচ্ছে। কিন্তু এসবের সবচেয়ে বড় মূল্য দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। তাঁরা হারাচ্ছেন চাকরি, হারাচ্ছেন আয়, হারাচ্ছেন মর্যাদা—সবচেয়ে বেশি হারাচ্ছেন জীবনের নিশ্চয়তা।
পোশাকশিল্পের এই সংকটে আরেকটি দুঃখজনক বিষয় একের পর এক রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ড। গত ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) অবস্থিত অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইলস লিমিটেড বা আল হামিদ টেক্সটাইলসে ভয়াবহ আগুনে ৯ তলা ভবনের ৫, ৬ ও ৭ তলা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১৭ ঘণ্টা ধরে চলা এই আগুনে পুড়ে গেছে বিপুল কাপড় ও কাঁচামাল। শত শত শ্রমিক হঠাৎ কাজ হারিয়েছেন।
যদিও কর্তৃপক্ষ ৪৫ দিনের লে-অফ ঘোষণা দিয়ে বেতন চালু রাখার আশ্বাস দিয়েছে, বাস্তবে তা অনেক সময়ই ভেস্তে যায়। একটি কারখানার আগুন মানে শুধু ভবন পোড়া নয়, এটি শত শত স্বপ্নের মৃত্যু।
এর পরপরই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনে ৫১৬টি কারখানার প্রায় ১০০ কোটি টাকার স্যাম্পল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর প্রভাব সরাসরি পড়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থার ওপর। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো যখন বাংলাদেশের উৎপাদনকাঠামোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তখন নতুন অর্ডার স্থগিত বা বাতিল হয়, যার ফল ভোগ করেন শ্রমিকেরাই। বড় কারখানাগুলো হয়তো কোনোভাবে ধাক্কা সামলে নিতে পারে, কিন্তু ছোট কারখানাগুলোর জন্য এটি একরকম মৃত্যুঘণ্টা।
বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের (বিএলএফ) এক জরিপে দেখা গেছে, তৈরি পোশাক খাতে ৩২ শতাংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরিরও কম আয় করেন। এর চেয়ে ভয়াবহ তথ্য; ৭৮ শতাংশ শ্রমিক তাঁদের পরিবারকে পর্যাপ্ত খাদ্য জোগাতে পারেন না। অভাবের তাড়নায় প্রতি আটজনের মধ্যে একজন শ্রমিক ঋণের জালে আটকা পড়েছেন। এই পরিসংখ্যান কেবল অর্থনৈতিক নয়—এটি মানবিক ট্র্যাজেডি। যে মানুষটি ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে সারা দিন মেশিনের শব্দের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, রাতে ঘরে ফিরে সন্তানের মুখে খাবার দিতে না পারার কষ্টে চোখের পানি চেপে রাখেন, তিনি কেবল শ্রমিক নন, তিনি এই জাতির মেরুদণ্ড। অথচ সেই মেরুদণ্ড আজ ভেঙে পড়ছে।
বাংলাদেশের কারখানাগুলোর বাস্তবতা আরও কঠিন। সাব-কন্ট্রাক্টেড ও মিশ্র ধরনের অনেক ফ্যাক্টরিতে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি শিফট কাজ করা সাধারণ ঘটনা। আইনে যতই আট ঘণ্টা নির্ধারণ থাকুক, বাস্তবে তা প্রায়ই মানা হয় না। তদুপরি, শিশুশ্রম এখনো এই খাত থেকে নির্মূল হয়নি। শিশুশ্রমিকদের প্রায় ৮০ শতাংশই অনিয়ন্ত্রিত সাব-কন্ট্রাক্টেড কারখানায় কাজ করে। তাদের ৯৯ শতাংশ সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করে এবং অনেকেরই বয়সসংক্রান্ত নথি জাল করা হয়। এই নির্মম বাস্তবতা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়—আমরা কীভাবে উন্নয়নের দাবিদার হতে পারি, যখন শিশুদের শৈশব পোশাকের কারখানার তাপে পুড়ে যায়?
যে শ্রমিকেরা বৈষম্য নিরসনের দাবিতে জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, এবার পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই আন্দোলনের পরও তাঁদের জীবনে কোনো আলো জ্বলেনি। বরং বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি ও ঋণের চাপে তাঁদের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়েছে। তাঁদের এই হতাশা কেবল আর্থিক নয়, এটি মানসিকও। যখন একজন শ্রমিক তাঁর সন্তানের স্কুলের ফি দিতে পারেন না, যখন অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি শুধু একজন বেকার মানুষ নন, তিনি হয়ে ওঠেন সমাজের এক অদৃশ্য আর্তনাদ।
বেকারত্ব শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি সমাজের স্থিতি ও শান্তির প্রশ্ন। যখন লাখো শ্রমিক কাজ হারান, তখন শুধু তাঁদের পরিবার নয়, সমাজও অস্থির হয়। অভাব জন্ম দেয় সামাজিক অপরাধ, মানসিক ভাঙন ও প্রজন্মের হতাশা। আজ বাংলাদেশের তরুণসমাজও একই বাস্তবতায় আক্রান্ত। উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা কাজ খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা, অন্যদিকে অভিজ্ঞ শ্রমিকেরা কাজ হারিয়ে নিঃস্ব। একদিকে দক্ষ জনশক্তি দেশ ছাড়ছে, অন্যদিকে দেশীয় শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে। এই দ্বৈত সংকট ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ বার্তা।
এই সংকটের সমাধান কেবল অর্থনীতির ভাষায় সম্ভব নয়; দরকার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিটি বেকার শ্রমিক একটি পরিবারের গল্প, প্রতিটি বন্ধ কারখানা একটি সমাজের ব্যর্থতার প্রতীক। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত এই সংকটকে কেবল পরিসংখ্যান নয়, একটি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা। সরকারের পাশাপাশি শিল্পমালিকদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। শ্রমিককে কেবল উৎপাদনের হাতিয়ার নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান করতে হবে। শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, পুনর্বাসন এবং ন্যূনতম জীবিকা নিশ্চিতে সরকার ও মালিকপক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। আন্তর্জাতিক বায়ার ও উন্নয়ন-সহযোগীদেরও এখানে ভূমিকা আছে। তারা শুধু ‘কম দামে বেশি উৎপাদন’ নয়, বরং ‘মানবিক উৎপাদন’কে অগ্রাধিকার দিলে তবেই এই শিল্প টিকে থাকবে।
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা কেবল অর্থনীতির চালক নন; তাঁরা জাতীয় আত্মমর্যাদার প্রতীক। কিন্তু আজ সেই প্রতীকের ওপরই আঘাত লেগেছে। যদি আমরা এই সংকটকে উপেক্ষা করি, তাহলে শুধু শ্রমিক নয়, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বেকারত্বের অভিশাপ কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়—এটি এক মানবিক বিপর্যয়। তাই এখনই সময় মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার, শ্রমিকের কণ্ঠ শোনার, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর। অর্থনীতির পরিসংখ্যান হয়তো কিছু সময় পর পাল্টে যাবে, কিন্তু এক শ্রমিকের কান্না যদি সমাজের বিবেকে না পৌঁছায়, তবে উন্নয়নের সব দাবি অর্থহীন হয়ে পড়বে। শ্রমিকের অশ্রু মুছে ফেলার দায়িত্ব আমাদের সবার। মানবিক বাংলাদেশ গড়তে হলে প্রথমে মানবিক চোখে শ্রমিককে দেখতে শিখতে হবে।